সিয়াম সাধনার পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে। এখন শীতকাল নয়, চৈত্র মাস। সারা দেশে চলছে ভ্যাপসা গরম। আবাসিক গ্রাহকদের নতুন গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ। তারপর ও রাজধানীর তীব্র গ্যাস সংকট। রমজানের প্রথম দিন গতকাল রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় গ্যাস ছিল না। কোথাও গ্যাস থাকলেও চুলা জ্বলেছে নিভু নিভু। গ্যাস প্রবাহ কম থাকায় কোনো কিছুই রান্না সম্ভব হয়নি। ফলে রোজার প্রথম দিন সাহরি ও ইফতারে দুর্গতিতে পড়তে হয রোজাদারদের। কেউ হোটেল থেকে কিনে, কেউ এটা সেটা দিয়ে সাহরি খেয়ে রোজা রাখেন। ইফতারের সময়ও একই অবস্থা। গ্যাস না থাকায় বাজার থেকে কিনে কেউ মুড়ি-চিড়া দিয়েই ইফতার করতে বাধ্য হন।
জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ পুরো বিষয়টি অস্বীকার করে ইনকিলাবকে বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ফোন পেয়েছি। গ্যাস সংকট চলছে। এটা আমাদের সমস্যা নয়। এটা জাতয়ি সমস্যা। তবে সংকট কাটানোর জন্য কাজ করা হচ্ছে। গ্যাসের সঙ্কট এখনও খুব বেশি হচ্ছে না। পিক আওয়ারে না থাকলেও বিকেল বা সন্ধ্যার পর গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিকই থাকে।
জানা যায়, গত ২৯ মার্চ সচিবালয়ে আসন্ন রমজান ও চলতি গ্রীম্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গ্যাসের ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে দেশের বেশিরভাগ শিল্পকারখানা। করোনার ধাক্কা সামলে এলাকার শিল্পখারখানাগুলোতে কাজ চলছে পুরোদমে। মিলছে রপ্তানি আদেশও। কিন্তু গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন না হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। কারখানাগুলোতে জেনারেটর ও বয়লার চালু রাখতে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ১৫ পিএসআই গাসের চাপ প্রয়োজন। কিন্তু দিনে গ্যাসের চাপ কম থাকার পাশাপাশি সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে না। রাজধানীর বিভিন্ন অংশে তীব্র গ্যাস সংকট শুরু দেখা হয়েছে। গত শনিবার রাতে থেকে শুরু হওয়া গ্যাস সংকটে চরম বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা। গতকাল রোববারেও এমন ঘটনা। রমজানের প্রথম দিন সকাল থেকে বিকাল লাইনে গ্যাস আসছে না। যা আসছে তার তাপ খুবই কম। সেটি দিয়ে দুপুরে রান্নাও করা যাচ্ছে না। অনেক পরিবার ইফতার ও রান্না করতে পারেনি। শিল্প মালিকরা বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস না পাওয়ায় রোটেশন করে কারখানা চালু রাখতে হয়, এতে নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস না পেলে রপ্তানি আদেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও জানান তারা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ইনকিলাবকে বলেন, গ্যাস সরবরাহ সঙ্কট সাময়িক। শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহকে চ্যালেঞ্জ। শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কাজ চলমান বলেও জানান তিনি। জাতীয় স্বার্থে শিল্প খাতে গ্যাস-বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ব্যবহারের পরামর্শও দিয়েছেন।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির স্থানীয় ব্যবস্থাপক মোস্তফা মাহবুব বলেন, গ্যাস স্বল্পতার কারণ খতিয়ে দেখছেন তারা।
রমজানের প্রথম দিনই রাজধানীতে গ্যাসের হাহাকার শুরু হয়েছে। গতকাল রোববার রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় দুপুরের পর থেকেই ছিল না গ্যাস। কোথাও থাকলেও তা এত কম ছিল যে পানিও গরম করা যাচ্ছিল না। রাজধানীর নতুনবাজার এলাকাও একই অবস্থা। এখানে সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। এই এলাকায় এখন সিলিন্ডারই ভরসা। যাদের সিলিন্ডার নেই তারা ভোরে রান্না করেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, আদাবর, কল্যাণপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের এমন সঙ্কট চলছে। দেশের বড় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি বিবিয়ানা। সেই ক্ষেত্রের ছয়টি কূপ বন্ধ। যার প্রভাব পড়েছে ঢাকায়। সংকট কাটতে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় লাগবে বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা। গতকাল গ্যাসের সঙ্কট দেখা গেছে ঢাকার মোহম্মদপুর, রায়েরবাজার, ধানমন্ডি, শংকর, কাঁঠালবাগান, কলাবাগান, রামপুরা, ওয়ারী, মগবাজার, বনশ্রী, গোপীবাগ, মিরপুর, ইস্কাটন, মানিকদিসহ আরও কিছু এলাকায়। পশ্চিম ধানমন্ডির বাসিন্দা আমেনা মুক্তা জানান, দুপুর পর্যন্ত মোটামুটি গ্যাস ছিল। দুপুরের পর একেবারেই নেই। ইফতারের কিছুই রান্না করতে পারিনি।
ইস্কাটনের বাসিন্দা হাফিজা জানান, সকাল থেকেই গ্যাসের চাপ কম। দুপুরের পর আরও কমে গেছে। একই অভিযোগ মিরপুরের বাসিন্দা তাহেরা বেগম ও গোপীবাগের নাসির। মতিঝিল থেকে হাসান সোহেল জানান, মোটেও গ্যাস নেই। চুলাই জ্বলছে না।’ উত্তরা-৪ থেকে নওরিন জানান, শনিবার কাল রাত থেকেই গ্যাস নেই। এখনও আসেনি। ইফতার বানাতে না পেরে দোকান থেকে কিনে এনেছি। একই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মোহাম্মদপুর, মগবাজার, রায়েরবাজার, কলাবাগান, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, কদমতলী, ডেমরা, কাঁঠালবাগান, রামপুর, বনশ্রী ও মিরপুরের বাসিন্দারা।
গতকাল বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তি এবং মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ফেইসবুক পেইজের একটি পোস্টে জানা গেছে, বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রের জরুরি মেরামত ও সংরক্ষণ কাজের জন্য গ্যাস সরবরাহে ঘাটতিজনিত কারণে কিছু কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটছে। ফলে কোনও কোনও এলাকায় সাময়িকভাবে সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে। এই অসুবিধার জন্য মন্ত্রণালয় আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছে। পেট্রোবাংলা স্ত্রূ সূত্রে জানা গেছে, বিবিয়ানার ছয়টি কূপ থেকে গত রাতে গ্যাস উত্তোলনের সময় বালি উঠতে শুরু করে। এ কারণে বন্ধ করে দিতে হয় উৎপাদন। এতে রাতে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সংকট দেখা দেয়। আবাসিক এলাকায় সাধারণত প্রায় ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এখন সরবরাহ হচ্ছে প্রায় ১৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান ইনকিলাবকে বলেন, হঠাৎ বিবিয়ানায় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। কিছুই করার ছিল না। আমরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। বিকাল নাগাদ একটি কূপ মেরামতের কাজ শেষ হয়েছে। আগামীকালের মধ্যে আরও তিনটি কূপ উৎপাদনে আসবে বলে আশা করছি। এরপর আরও একটি কূপ চালুর কথা। তবে একটি কূপ মেরামত করতে সময় লাগবে জানিয়েছে শেভরন। ফলে ৭০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো ঘাটতি থেকে যাবে। ৮ এপ্রিল আমাদের একটি এলএনজির কার্গো দেশে পৌঁছাবে। এরপর ১০ এপ্রিল নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছি। একই কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহেও ঘাটতির শঙ্কা তৈরি হলো। কারণ, দেশের প্রায় অর্ধেক কেন্দ্র এখনও গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। নাজমুল আহসান বলেন, চেষ্টা করছি বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে। এখন তো গরম। চাহিদা এমন সময় বেশি থাকে। ইফতার, তারাবি ও সাহরির সময় যাতে বিদ্যুৎ সঙ্কট না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে।
নতুনবাজার এলাকার বাসিন্দা শাহিন আল, বলেন, নতুনবাজার এলাকায় রাত থেকে তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। আমাদের এখন সিলিন্ডারই ভরসা। শীত আসলে গ্যাস থাকে না আবার গরম থাকে না। রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা ফজিলা বেগম বলেন সব প্রস্তুতি সেরে দুপুরের রান্নার জন্য গ্যাসের চুলা জ্বালাতে গিয়ে দেখলেন টিমটিম করে জ্বলছে। হাড়ি চড়ানোর দু-তিন মিনিটের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় চুলা। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এখনো রোজা শুরু। তার আগে এ অবস্থা হয় তবে শীত এলে কি অবস্থা হবে জানি না। মোহাম্মদপুর নুরজাহান রোড়ের বাসিন্দার সালমা রশিদ বলেন, গ্যাস সঙ্কটের কারণে দুপুরের রান্না করতে না পেরে অসহনীয় দুর্ভোগ হচ্ছে। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের জরুরি অভিযোগ কেন্দ্রে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন অর্ধশতাধিক নাগরিক গ্যাসের চাপ কম থাকা কিংবা হঠাৎ গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হওয়ার অভিযোগ করছেন। সামনে সঙ্কট আরও বাড়তে পারে বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন।