টানা প্রায় দুই সপ্তাহের চলমান তাপপ্রবাহে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তীব্র গরমের ফলে সারাদেশে সর্দি-জ্বর, ডায়রিয়াসহ নানান রোগ ছড়াচ্ছে। এ ছাড়া হিটস্ট্রোকেও আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। দেশের উত্তারাঞ্চলে গরমের প্রভাব ভয়াবহ রূপধারণ করেছে। প্রচন্ড গরমের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রাণহানি ঘটছে। রংপুরের বিভাগীয় স্বাস্থ্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন দিনে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধায় এ পাঁচ জেলায় গরমজনিত কারণে অন্তত ৭০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। হিটস্ট্রোকে গত দু’দিনে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩ জনের মৃত্যুর হয়। বিভিন্ন রোগে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন শত শত রোগি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। প্রচণ্ড গরম ফরিদপুরে রোজ হাসপাতালে ৫০০ শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে। সারাদেশে ৩ হাজারেরও বেশি মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। বিশ্বের শীতপ্রধান মহাদেশ ইউরোপে তাপপ্রবাহের কারণে ইতোমধ্যে বেশ প্রাণহানি ঘটেছে। বিভিন্ন বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়েছে স্পেন ও পর্তুগালে এরই মধ্যে হিটস্ট্রোকে ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
চলমান তাপপ্রবাহের কারণে দেশে প্রায় ঘরে ঘরে মানুষ সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। ডায়রিয়া, আমাশয়সহ, কাশি ও নানান চর্মরোগও ছড়াচ্ছে। জ্বর আর ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা হাসপাতালগুলোতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৃদু এ তাপ প্রবাহের মধ্যে কোথাও অতিরিক্ত জনসমাগম হলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি রয়েছে। গরমের দিনে মারাত্মক সমস্যার একটি হিট স্ট্রোক। এর প্রধান কারণ পানিশূন্যতা। মানব দেহে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট। প্রচণ্ড গরমে মানুষের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে প্রবল। এ অবস্থায় শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে হিট স্ট্রোক হয়। হিট স্ট্রোকের লক্ষণগুলো হলোÑ মাথা ঝিম ঝিম করা, বমি বমি ভাব বা বমি করা, অবসাদ ও দুর্বলতা, মাথাব্যথা, মাংসপেশির খিঁচুনি, চোখে ঝাঁপসা দেখা, হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি, শ্বাসকষ্ট, দৃষ্টিবিভ্রম, খিঁচুনি ইত্যাদি। গরমে বিপাকে পড়েছেন ভ্যানচালক, রিকশাচালক, খেটেখাওয়া দিনমজুরসহ নিম্ন আয়ের মানুষজন। প্রখর রোদ ও তাপ উপেক্ষা করে ভোগান্তি নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে এসব শ্রমজীবীদের।
গ্রীনহাউজ নি:সরণের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যেন ইটভাটার বয়লারে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে এখন একই সাথে তাপপ্রবাহ চলছে। বেশ কিছুদিন থেকে বাংলাদেশেও তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বিরাজমান রয়েছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ভারি বৃষ্টি না হলে সামনের কিছুদিন তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। স্পেনে গত দুই সপ্তাহ যাবৎ তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠেছে। পর্তুগালের তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তাপমাত্রা কমবেশি এমনই। আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের তাপমাত্রাও ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য মতে, বাংলাদেশে গত এক সপ্তাহে রাজশাহী এবং রংপুরের সৈয়দপুরে সর্বোচ্চ ৩৯ ডিগ্রী তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। গতকালও দেশের টাঙ্গাইল, সিলেট ও চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরণের তাপপ্রবাহ বইছে এবং তা আরও দুইদিন অব্যাহত থাকতে পারে।
পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, জলবায়ু এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনের জন্য আমরা দায়ি না হলেও এর বিরূপ প্রভাবে চরমভাবে ভুক্তভোগি। বৈশ্বিক উষ্ণানয়নের ফলে প্রকৃতিতে শৈত্যপ্রবাহ, খরা ও অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টির মতো নানা বৈরিতা এখন বাস্তবতা। বিশ্বের প্রতিটি দেশে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। উন্নয়নের নামে খালবিল, ডোবা-নালা এসব ক্রমাগত ভরাট করে, নির্বিচারে দেশের বনভূমিকে ধ্বংস করে আমরা পরিবেশের সর্বনাশ করছি, সেই সাথে নিজেদের চরম বিপদ ডেকে আনছি। গ্রীনহাউজ নি:সরণ বাড়ছে এবং সেই সাথে নানা প্রকৃতিক দুর্যোগ। এসব দুর্যোগ থেকে বাঁচতে খালবিল, নদীনালা ও ডোবাগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। শহর-গ্রামে সবুজের আধিক্য আরও অনেক বাড়াতে হবে। গ্রিনহাউস নিঃসরণ কমানো না গেলে সবার জন্য আগামীতে আরও ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে। গবেষকদের বিশ্নেষণ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ২০৩৭ সাল নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণতা এখনকার তুলনায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। আর ২০৫১ সাল নাগাদ তা আরও ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সারা বিশ্বেই এখন একট হয়ে দেখা দিয়েছে। অস্বাভাবিক তাপে, গরমে পুড়ছে ইউরোপ, আমেরিকা, চীনসহ এশিয়ার বিশাল অংশ। ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগালের কবলিত এলাকা থেকে গতকাল হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ইউরোপের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সামনের দিনগুলোতে আরও তাপদাহের আশঙ্কা প্রকাশ করে স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করেছেন। বহুদেশে তাপমাত্রা এরই মধ্যে ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। শীতপ্রধান শহর হিসেবে পরিচিত ছিল ফিনল্যান্ডের রোভানিইমি। তবে এবার রুদ্ররূপ ধারণ করেছে ওই শহরের তাপমাত্রা। সেখানেও এখন তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। ফ্রান্সে দাবানলের আগুন নিয়ন্ত্রণে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে দেশটির সরকার। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে রেড অ্যালার্ট জারি হয়েছে চীনের বাণিজ্যিক রাজধানী সাংহাইসহ ৮৬টি শহরে। দিন দিন তাপমাত্রা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে যে রাস্তায় ফাটল দেখা যাচ্ছে। এমনকি বাড়ির ছাদের টালিতেও ফাটল ধরতে দেখা গেছে। জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত দেশটির জনজীবন। টোকিওর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর ইসিসাকিতে তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘনঘন তাপপ্রবাহ হচ্ছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব উষ্ণায়ন বেড়ে তাপপ্রবাহ আরো তীব্র হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক এক পুতবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীতে আগুন জ্বলছে। ইতিমধ্যে সমস্ত জলবায়ু সূচক রেকর্ড ভঙ্গ করে চলেছে, পুরো বিশ্ব জলবায়ুই বিপর্যয়ের সম্মুখীন।
রংপুর থেকে হালিম আনছারী জানান, তীব্র দাবদাহে পুড়ছে রংপুরসহ গোটা উত্তর জনপদ। তীব্র দাবদাহ আর ভ্যাপসা গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। হাঁসফাঁস অবস্থা বিরাজ করছে প্রাণীকূলেও। বেড়ে চলেছে সর্দি-জ্বরসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা। বাসা-বাড়ি, অফিস কিংবা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান সবখানেই চলছে অস্থিরতা। শান্তি মিলছে না কোথাও। বরং প্রতিদিনই তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। এই অবস্থায় প্রশান্তির একমাত্র উপায় বৃষ্টির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে এ অঞ্চলে। বৃষ্টির অভাবে মাটি ফেটে আমন ধানের চারা মরে যাচ্ছে। প্রচণ্ড তাপে রাস্তার পিচ উঠে যাচ্ছে। হিটস্ট্রোকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩ জনের মৃত্যুর হয়। বিভিন্ন রোগে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন শত শত রোগি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
গতকাল রংপুরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৬.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন শনিবার ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা বৃদ্ধি আরও ২ থেকে ৩ দিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানিয়েছেন, গত প্রায় ১০ দিন ধরে রংপুর অঞ্চলে অস্বাভাবিক আবহাওয়া বিরাজ করছে। সূর্য কিরণ লম্বালম্বিভাবে আসায় রোদের তীব্রতা অনেক বেশি এবং তীব্র গরম অনুভব হচ্ছে। এই গরম বাতাস স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে। এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি আরও ২ থেকে ৩ দিন অব্যাহত থাকতে পারে।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে গত শুক্রবার নগরীর হাজিপাড়া এলাকার দোয়েল নামে এক যুবক হিটস্ট্রোক করে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়। এছাড়া গত বুধবার এবং শনিবার আরও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে, অব্যাহত দাবদাহে শহর কিংবা গ্রামের রাস্তা-ঘাট ও হাট-বাজারগুলোতে মানুষের উপস্থিতি কমে গেছে। কারো পক্ষেই বাহিরে থেকে কাজ-কর্ম করা সম্ভব হচ্ছে না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাবদাহের তীব্রতা বেড়ে গিয়ে অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে যায় এবং রাত অবধি তা অব্যাহত থাকে। জৈষ্ঠ্য মাসে শেষ এবং আষাঢ়ের শুরুর দিকে কয়েকদিন বৃষ্টি হলেও গত প্রায় ২০দিন ধরে এ অঞ্চলে বৃষ্টির দেখা মিলছে না। এদিকে তীব্র তাবদাহের কারণে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা। হাসপাতালে বেড না থাকায় ফ্লোরেও রাখা হয়েছে অসংখ্য রোগী।
এদিকে ফরিদপুরে বিরাজ করছে প্রখর দাবদাহ। প্রচণ্ড গরমে কষ্ট পাচ্ছেন সব বয়সী মানুষ। তবে গরমের কারণে আবহাওয়াজনিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শিশুদের অসুস্থতার হার কয়েকগুণ বেড়েছে। এ ব্যপারে শিশু হাসাপতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মৃত্যুঞ্জয় সাহা বলেন, গরমের তীব্রতা বেড়েছে। ফলে প্রতিদিনই প্রায় চারশ’ থেকে পাঁচশ’ শিশু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে।
এদিকে টানা তিনদিন ধরে চলমান তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কুড়িগ্রামবাসীর জনজীবন। গরমে প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন না মানুষজন। বিশেষ করে বিপাকে পড়েছেন ঘোড়ার গাড়িচালক, ভ্যানচালক, রিকশাচালক, খেটেখাওয়া, দিনমজুরসহ নিম্ন আয়ের মানুষজন। প্রখর রোদ ও তাপ উপেক্ষা করে ভোগান্তি নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে দেখা গেছে এসব শ্রমজীবীদের।