অকালে ঝরছে তাজা প্রাণ। কিছুতেই রোখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা ফের ভাবিয়ে তুলছে। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রকট আকার ধারণ করেছিল করোনার স্থবিরতায়। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু থাকার পরও আত্মহত্যা করছেন শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অমিত কুমার বিশ্বাস হলের ছাদ থেকে পড়ে আহত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। অমিতের রুম থেকে মেলে ‘সুইসাইড নোট’। অমিত সুইসাইড নোটে লেখেন- আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না। আমার মস্তিষ্কই আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী
আমি নিজেই নিজের শত্রু হয়ে পড়েছি অজান্তেই। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আমি ক্লান্ত। আর না। এবার মুক্তি চাই। প্রিয় মা-বাবা, ছোট বোন- সবাই পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। এছাড়া অমিতের পড়ার টেবিলে আরও কয়েকটি সুইসাইড বিষয়ক মন্তব্য লেখা পাওয়া যায়। এর মধ্যে ছিল- মানুষ তার জৈবিক চাহিদার জন্য আত্মহত্যা করে না, আত্মিক আশায় টান পড়লে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তবে অমিতের রুমমেট রবিন ঘোষ বলেন, অমিত খুবই ভালো ছেলে। তার কোনো ধরনের হতাশা ছিল না। ও নিয়মিত মেডিটেশন করতো। তবে ইদানীং একটু অসুস্থ ছিল। এছাড়া কোনো ধরনের সমস্যা ছিল না। মৃত্যুর দিন দুপুরে আমরা বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে খাবার খেয়েছি। পরে সে হলে চলে আসে। কিছুক্ষণ পর শুনি সে ছাদ থেকে পড়ে গেছে।
অমিতের পিতা অজয় কুমার বিশ্বাস জানান, তাদের পারিবারিক কোনো ঝামেলা ছিল না। গত ৭ তারিখ ছেলেকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েছিলেন ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। পরিবারের সঙ্গে তেমন কোনো মনোমালিন্যও হয়নি।
মঙ্গলবার হতাশার কথা জানিয়ে ‘সুইসাইড নোট’ লিখে আত্মহত্যা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া তাবাসসুম। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, সাদিয়ার মাঝে বেশকিছু সময় লেখাপড়া বন্ধ ছিল। যে কারণে তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। মঙ্গলবার দুপুরে নিজ ঘরে বাঁশের আড়ার সঙ্গে গলায় ফাঁস দেন সাদিয়া। পরিবারের লোকজন বিষয়টি টের পেয়ে তাকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। মৃত্যুর আগে সাদিয়া তার বাবার ডায়েরিতে লিখে গেছেন- চোরাবালির মতো ডিপ্রেশন বেড়েই যাচ্ছে, মুক্তির পথ নেই, গ্রাস করে নিচ্ছে জীবন, মেনে নিতে পারছি না।
এ ছাড়াও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অঙ্কন বিশ্বাসের চলে যাওয়াও বেশ আলোচনায় আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদের সঙ্গে এক মাস আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। এরপর দাম্পত্য কলহের জেরে ২৪শে এপ্রিল অঙ্কন শাকিলের বাসায় বিষপান করেন। এর ১৫ দিন পর গত শনিবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়।
আত্মহত্যার বিষয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য সামনে এনেছে আঁচল ফাউন্ডেশন। সংগঠনটি বলছে, ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। অনুসন্ধানে আত্মহননের পেছনে পারিবারিক সমস্যা, হতাশা, সম্পর্ক নিয়ে জটিলতা ও আর্থিক সমস্যাসহ বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরেন।
সংগঠনটি বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা যেসব কারণে আত্মহত্যা করছে তার অন্যতম কারণ সম্পর্কের অবনতি। আত্মহত্যাকরীদের ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশই বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কের অবনতির কারণে আত্মহত্যা করেছেন। এরপর রয়েছে পারিবারিক সমস্যা। যার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন সম্পর্কের অবনতিতে ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ পারিবারিক সমস্যায় শতাংশ ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ, পড়াশোনা-সংক্রান্ত কারণে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ, আর্থিক সমস্যায় ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ, মাদকাসক্ত হয়ে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যার প্রবণতাকে ভয়ঙ্কর বলে বর্ণনা করেছেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব সিনসিনাতির মনোবিদ অধ্যাপক ড. জন পি. প্যাসটেইন। ২০১৩ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা যারা করেন তারা নিজের সমস্যাকে অধিকতর গোপন রাখার চেষ্টা করেন। এ ছাড়াও এই ধরনের মানুষ জীবিত অবস্থায় অন্যকে বুঝতে দিতে চান না। নিজের মাঝে থাকা হতাশাগুলো শেষ মুহূর্তে প্রকাশের মাধ্যমে অন্যকে অপরাধী করবার একটা প্রবণতা থাকে। যার মাধ্যমে তার স্বজনরা শেষ সময়ের না বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবতে থাকেন। যার ফলে তার স্বজনরাও আজীবন অপরাধবোধ রাখেন। আর অধিকাংশই স্ব-ইচ্ছায় আত্মহত্যা করছেন তা লিখে যান। যাতে তার আত্মহত্যা নিয়ে পরবর্তীতে কেউ জটিলতায় না পড়েন।
তিনি আরও বলেন, একাধিক সুইসাইড নোট বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সব নোটেই ছিল হতাশার কথা। সেইসঙ্গে পরিবার ও আপনজনদের প্রতি ক্ষমা চাওয়ার প্রবণতা। এর উত্তরণের উপায় হিসেবে বলেন, প্রত্যেক মানুষের একটি আগ্রহের স্থান থাকে। সেগুলোর ওপর তার ভবিষ্যৎ কর্ম ঠিক করা উচিত। এ ছাড়াও যারা শিক্ষার্থী তাদের মানসিক অবস্থা ভেদে প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক সুস্থ পরিবেশ খুবই জরুরি।
দেশে সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনার সুইসাইড নোটেও হতাশার বিষয়টি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। কয়েকজনের নোটে লেখা ছিল- ‘ক্ষমা করো আম্মু। আমি আর পারলাম না’, ‘জীবনের কাছে হার মেনে গেলাম, আমি আর পারলাম না’, ‘সরি দাদি মা। কারো জন্য কিছু করতে পারলাম না। মরাটা এতো সহজ না তবুও চলে গেলাম’। সকলেই লিখেছেন আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
আত্মহত্যা প্রতিরোধ নিয়ে অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনা করছে ‘এন্টি সুইসাইডাল স্কোয়ার্ড’। এর একজন প্রধান সমন্বয়ক সুজন আহমেদ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর আমরা লক্ষ্য করছি শিক্ষার্থীরা করোনার স্থবিরতার হতাশাগুলো থেকে মোটেই বেরিয়ে আসতে পারছেন না। এই সময় অনেক শিক্ষার্থীই পারিবারিক ও প্রেমঘটিত সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছেন। এ ছাড়াও কর্মহীন সময়ে অনেকে নানা মাদক গ্রহণ শুরু করেছেন। সেই সঙ্গে কিছু ছোট অপরাধেও জড়িয়েছেন। এসব কারণে এখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলেও হতাশা থেকে বের হতে পারছেন না।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. মো. মুহিত কামাল বলেন, মেঝেতে তেলাপোকা মরে পড়ে থাকলে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু মানুষের মন মরে থাকলে আমরা দেখতে পাই না। হতাশায় কেউ নিমজ্জিত হচ্ছে কিনা তা বুঝতে হবে। সামাজিকভাবে কেউ নিজেকে আড়াল করে ফেলছে কিনা, বুঝতে হবে। আত্মহত্যা রুখতে দরকার সুস্থ পরিবেশ। আর কারও মানসিক সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি।