দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের খনি আবিষ্কারের উজ্বল সম্ভবনা থাকলেও গ্যাস অনুসন্ধানে কূপ খননে আগ্রহ দেখাচ্ছে না
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বাপেক্স)। দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন থেকে গ্যাস অনুসন্ধানের দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স গ্যাস অনুসন্ধানে অনীহা দেখিয়ে আসছে। গ্যাস অনুসন্ধানে আর্থিক সঙ্গতি নেই, কারিগরি তথা প্রযুক্তি দুর্বল ইত্যাদি অজুহাত দেখিয়ে বঙ্গোপসাগর ও অন্যান্য স্থানে গ্যাস অনুসন্ধান থেকে বিরত রয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশ। এ খাতে নতুন পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। গ্যাস কূপ খননের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হচ্ছে। কিন্তু পুরনো অভিজ্ঞতার কারণে জ্বালানি খাতের বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে অস্বস্তি ও অবিশ্বাস থেকেই যায়। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রতিবেশি ভারত ও মিয়ানমার থেকে যোজন যোজন পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
আধুনিক ইকুইপমেন্টের অভাবে দেশিয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স কোনো অনুসন্ধান চালাতে পারছে না। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হলেও দীর্ঘ ১০ বছরেও অনুসন্ধান শুরু করেনি বাংলাদেশ। গ্যাসের ব্লকগুলো ইজারা দেওয়ার জন্য করোনার আগে দরপত্র আহ্বান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে আবার সেই প্রক্রিয়া বন্ধ বয়েছে। এরই মধ্যে মিয়ানমার তাদের সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করে এবং গ্যাস উত্তোলনও শুরু করেছে। ভারতও তাদের সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করেছে। একটি ব্লকে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে। ভারতর আগামী ২০২৩ সালে ওই ব্লক থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু কবরে বলে জানা গেছে। এদিকে শ্রীকাইল নর্থএ-১ গ্যাস কূপ খনন অনুসন্ধানে গত জুন মাসে এমডি উদ্ধোধন করেন। এ খনন কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং সরকারি টাকা লুটপাট করা হয়েছে এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায়ও গ্যাসের সম্ভাবনা অতি উজ্জ্বল। তারপরও দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস অনুসন্ধানে তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে বাংলাদেশকে এখন চাহিদা পূরণে উচ্চমূল্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ইনকিলাবকে বলেন, বাপেক্সের স্থলভাগে সক্ষমতা থাকলেও সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও উৎপাদনের সক্ষমতা নেই। তার পরও দেশিয় জ্বালানির উৎস অনুসন্ধানে কাজ করছে পেট্রোবাংলা। এ লক্ষ্যে ২০২২-২৫ সময়কালের মধ্যে সংস্থাটি মোট ৪৬টি অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার কূপ খননের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এরই অংশ হিসেবে বাপেক্স কর্তৃক রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের মাধ্যমে ভোলায় টবগী-১ নামক অনুসন্ধান কূপ খননের কাজ শুরু করা হয়েছে। বাকিগুলো করা হবে।
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম ইনকিলাবকে বলছেন, বাংলাদেশে জ্বালানি খাত পুরো আমদানি নির্ভর হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে। দেশকে অবিলম্বে গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ শুরু করতে হবে। ২০১২ সালে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। এরপর মিয়ানমার তাদের সীমায় জোরালো অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে বড় আকারের গ্যাসক্ষেত্রে আবিষ্কার করেছে।
জানা গেছে, গত ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি উভয় দেশের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। এই রায়ের আগে মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারত স্ব স্ব সমুদ্রসীমার কাছাকাছি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান সংক্রান্ত বিরোধে লিপ্ত ছিল। বিরোধ নিষ্পত্তির পর থেকে ভারত ও মিয়ানমার তাদের অফশোর ব্লকে দক্ষ তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানকারীদের সম্পৃক্ত করে সক্রিয় কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে তারা সফলতাও পেয়েছে। বাংলাদেশ যেকোন অফশোর অনুসন্ধান কর্মসূচিতে উদ্যোগী হওয়ার ক্ষেত্রে ধীর এবং কম সক্রিয় ছিল। ভূতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এখন বিশ্বাস করা হয় যে সমুদ্রসীমায় তিন দেশের সমস্ত অফশোর ব্লকগুলো সম্ভাব্য তেল এবং গ্যাস কাঠামো ধারণ করে।
পেট্রোলিয়াম পর্যবেক্ষকরা জানান, সীমানার উভয় পাশে একটি একক গ্যাস আবিষ্কার হলে, যে দেশ প্রথমে সেখানে খনন করবে তারা এটি থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি দেরিতেও গ্যাস পায় তাহলে ভারত-মিয়ানমারের তুলনায় কম লাভবান হবে। বাংলাদেশ বিডিং রাউন্ডটি শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি গুলো (আইওসি) থেকে শুধু উষ্ণ প্রতিক্রিয়া পেয়েছিল। বাংলাদেশ তখন ১১টি অফশোর ব্লকের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছিল। ২০১৪ সালে শুধুমাত্র ৩টি অগভীর সমুদ্র ব্লক আইওসি’কে দেওয়া হয়েছিল এবং গভীর সমুদ্রের ব্লকগুলোর জন্য কোনও কোম্পানি পাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত তেল জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর কোনটাই আবেদন করেনি।
আইওসি প্রতিনিধিদের মতে, অফশোরে অনুসন্ধানের জন্য আইওসিগুলোর জন্য প্রণোদনা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। গ্যাসের দাম নিয়ে আইওসি এবং সরকারের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন অববাহিকায় শ্বে, শোয়ে ফু এবং মিয়া গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে কোরিয়ান দাউই অয়েল এবং ভারতীয় ওএনজিসি’র কনসোর্টিয়াম। ভারতও দক্ষিণে অন্ধ্র প্রদেশের উপকূলে কৃষ্ণ-গোদাবরী অববাহিকায় গ্যাস আবিষ্কার করেছে।
ভূতত্ত্ববিদরা জানান, মিয়ানমারের রাখাইন অফশোর অববাহিকা এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অফশোর ব্লকগুলো ভূতাত্ত্বিকভাবে একই কাঠামোগত এককের অন্তর্গত যা ভাঁজ বেল্ট নামে পরিচিত। রাখাইন অববাহিকায় যে ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলো বৃহৎ গ্যাস পুল তৈরি করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ভূতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী অফশোর ব্লকগুলোতেও কাজ করা উচিত।
বাংলাদেশের অফশোর ব্লক এসএস-৯, এসএস-১০, এসএস-১১ এবং এসএস-১২ গ্যাসের জন্য সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রাখে। এছাড়াও, অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় অফশোর ব্লকগুলিতে হাইড্রোকার্বন থাকার উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের এখন ২৬টি অফশোর ব্লক রয়েছে যার মধ্যে ১১টি অগভীর সমুদ্র এবং ১৫টি গভীর সমুদ্র ব্লক। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর থেকে, বাংলাদেশ আইওসি’র সঙ্গে প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি) এর অধীনে মাত্র ৩টি অগভীর সমুদ্র এবং ২টি গভীর সমুদ্র ব্লক সক্রিয় করেছে। এ ৫টি ব্লক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কনোকোফিলিপস, অস্ট্রেলিয়ান স্যান্টোস, সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্রিস এনার্জি এবং ভারতীয় ওএনজিসি’র হাতে রয়েছে। এর মধ্যে কনোকোফিলিপসের রয়েছে দুটি ব্লক। এ কোম্পানিটি গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি তোলে এবং বনিবনা না হওয়ায় ২০১৪ সালে চলে যায়। এখন মাত্র তিনটি অফশোর ব্লক সক্রিয় রয়েছে। ২৩টি ব্লক উন্মুক্ত রয়ে গেছে এখনো। এটি কোন মান দ্বারা একটি যুক্তিসঙ্গত অনুসন্ধান প্রচেষ্টা নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ইউএসজিএসের ওই সমীক্ষাকে যাচাইয়ের জন্য কয়েক বছর পরে আরো গভীর অনুসন্ধান চালানোর উদ্যোগ নেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অধীন হাইড্রোকার্বন ইউনিট (এইচসিইউ)। এজন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে অর্থায়নের সুবিধাও পাওয়া যায়। অনুসন্ধান চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোভিত্তিক কনসালট্যান্সি ফার্ম গুস্তাভসন অ্যাসোসিয়েটসকে নিয়োগ দেয় এইচসিইউ। গুস্তাভসন অ্যাসোসিয়েটস তখন বৈশ্বিক জ্বালানি খাতে বেশ পরিচিত একটি নাম। প্রতিষ্ঠানটি জ্বালানি তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ উত্তোলনসংক্রান্ত জরিপের পাশাপাশি পরামর্শক সেবা দিয়ে আসছে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান, আলবেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আজারবাইজান, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ইতালি, মেক্সিকো, মঙ্গোলিয়া, নাইজেরিয়া, পেরু, রাশিয়া, তুরস্ক, উজবেকিস্তান এবং আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের জ্বালানি তেল এবং গ্যাস উত্তোলন খাতে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। গুস্তাভসনের সমীক্ষায় জানানো হয়, গ্যাসের মজুদ পাওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ, দেশের এমন খনিগুলোয় গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদের পরিমাণ ৩৮ টিসিএফ। ৫০ শতাংশ মজুদ সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলোয় এর পরিমাণ ৬৩ টিসিএফের কিছু বেশি। এ তথ্য ২০১১ সালে এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছিল গুস্তাভসন ও পেট্রোবাংলা। কিন্তু দেশের গ্যাস মজুদ নিয়ে গুস্তাভসনের তথ্য মোটেও বিশ্বাস করেনি সরকার। প্রতিবেদনটি গ্রহণও করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে জ্বালানি বিভাগের পক্ষ থেকে পরবর্তী সময়ে আর কোনো পদক্ষেপও নেয়া হয়নি। এ বিষয়ে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, আমি গাড়িতে আছি। পরে যোগাযাগে করেন।