স্বাস্থ্যকর খাবারের কথা বললেই তালিকার শীর্ষে থাকে ডিম। কিন্তু সেই ডিমের দামও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। একটি ডিম কিনতে এখন ব্যয় করতে হচ্ছে ১১ টাকা। মাংসের অগ্নিমূল্যের সময়ে যারা পুষ্টির অভাব পূরণে ডিমের ওপর নির্ভরশীল তাদের কপালেও এখন ভাঁজ পড়েছে। ডিমের দাম বাড়া প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা বলছেন, হাঁস-মুরগির খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ডিমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। খামারিদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় অনেকে খামার বন্ধ করে দিয়েছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা দোকান ঘুরে দেখা যায়, বাজারে বেড়েছে সব প্রকারের ডিমের দাম। সবচাইতে বেশি বিক্রি হওয়া ফার্মের মুরগির লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায়। কোথাও কোথাও এর চেয়ে বেশিও নেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে হাঁসের ডিমের ডজন ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা, দেশি মুরগির ডিমের ডজন ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা এবং ফার্মের মুরগির সাদা ডিম ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে একটি ফর্মের মুরগির লাল ডিম কিনতে ক্রেতাদের খরচ করতে হচ্ছে ১১ টাকা।
অন্যদিকে একটি সাদা ডিম কিনতে ১০ টাকা, দেশি মুরগির ডিম কিনতে ১৫ টাকা, একটি হাঁসের ডিম কিনতে ১৪ টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ এবং কাপাসিয়ায় ডিমের উৎপাদন বেশি হয়। অনেকে মুরগির খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় মুরগির খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। ছোট ছোট অধিকাংশ খামার বন্ধ হয়ে গেছে। যে কোম্পানিগুলো নিজেরা মুরগির খামার, খাবার উৎপাদন এবং ডিম উৎপাদন করে তারাই টিকে আছে। তাদের খুব একটা লোকশান হচ্ছে না। মুরগির ১০০ লাল ডিম আড়তে বিক্রি হচ্ছে ৯২০ টাকা, ১০০ সাদা ডিম ৮৬০ টাকা, ১০০ হাঁসের ডিম ১ হাজার ২০০ টাকা এবং ১০০ দেশি মুরগির ডিম ১ হাজার ৩০০ টাকা। দুই সপ্তাহ আগে হাঁসের ডিম ছিল ১ হাজার ৮০ টাকা।
শুধু পাইকারি বাজারে বেড়েছে তা নয়, অলিগলির খুচরা দোকানেও ডিমের দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা আরও জানান, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, ছোট খামার বন্ধ হয়ে উৎপাদন কমা এবং অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে ডিমের বাজারে। আড়তদাররা জানান, উৎপাদন খরচও বেড়েছে। আবার উৎপাদনও কমে গিয়েছে। অনেক ফার্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এতে সরবরাহও কমেছে।
তেজগাঁও ডিমের আড়তের ব্যবসায়ী মো. আব্দুল আলীম বলেন, মুরগির খাবারের দাম বাড়ার কারণে বাজারে ডিমের দাম বেড়েছে। গত ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করি। এই রকম ডিমের দাম বাড়ার রেকর্ড খুব কম দেখেছি। এ বছরই সর্বোচ্চ রেকর্ড। তেজগাঁও ডিমের সবচেয়ে বড় আড়ত। অনেকে এই ব্যবসা ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এখানে ১০৮টি দোকান ছিল। এদিকে অনেক খামারি খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। উৎপাদন কম। আমাদেরও বেশি দামে ক্রয় করতে হয়। উৎপাদন যত বেশি হবে দাম ততো কমবে।
কাওরান বাজারের খুচরা ও পাইকারি ডিম ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, ১০-১৫ দিন ধরে ডিমের দাম বাড়তি। বাজারে সবকিছুর দাম বেড়েছে। মুরগির খাবারের দামও বাড়তি। সবকিছু মিলিয়ে ডিমের ওপরও এর প্রভাব পড়েছে। আমাদেরও আড়ত থেকে বেশি দামে কিনতে হয়। খুব একটা লাভ থাকে না। বাজারে ক্রেতা কম। ক্রেতা থাকলেও খুব বেশি ডিম কিনতে চায় না। বর্তমানে হোস্টেল এবং হোটেলের মালিকরা ডিম বেশি কিনছে। সাদা ডিম তারা বেশি ব্যবহার করেন। এই ডিমের দাম একটু কম। ক্রেতাদের সাদা ডিমের চাহিদা বাড়ায় ১০০ ডিমে ২০ টাকা করে দাম বেড়েছে। এই ডিমের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কম।
এদিকে পাড়া মহল্লার দোকানে বাজারের চেয়েও ৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর আগারগাঁও, তালতলা ও শ্যামলীর দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে কোথাও কোথাও এক ডজন ফার্মের ডিমের দাম ১৩৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এ বিষয়ে দোকানদার মফিজ উদ্দীন বলেন, সরকারও তাদের ইচ্ছামতো সবকিছু করছে, বড় বড় ব্যবসায়ীরাও তাদের ইচ্ছামতো সবকিছু করছে। আমরা বেশি দামে কিনছি এজন্য বেশি দামে বিক্রি করছি। এটা সাধারণ হিসাব।
ক্রেতা রিজিয়া বেগম বলেন, প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় ডিম থাকে। কিন্তু ডিমের এত দাম বাড়ায় খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। আগে বাজারে আসলে দুই কেস একসঙ্গে নিয়ে যেতাম। এখন দুই হালি ডিমও নিতে পারছি না। অন্য বাজার তো দূরের কথা।
দিনমজুর খালিদ বলেন, কম দামে ডিম দিয়ে ভাত খাওয়া যেতো এখন এটির দামও বাড়িয়েছে। বাড়িতে ছোট ছেলে-মেয়েদের কী দিয়ে বোঝাবো। মাছ, মাংস তো চোখেই দেখি না। ভর্তা ভাত খেয়ে কতদিন থাকা যায়। আয় যা হয় তা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর।
দুই বন্ধু ইখলাস ও রিয়াজ কাওরান বাজারে এসেছেন। মেসে থাকেন। হোটেলে কাজ করেন। ইখলাস বলেন, মেসে থাকি। আজ বাসায় একটু ভালোমন্দ রান্না করে খেতে চাই। হোটেলের খাবার প্রতিদিন ভালো লাগে না। এজন্য কাওরান বাজারে এসেছি কেনাকাটার জন্য। একটি মুরগি নিয়েছি। ডিম কিনতে এসে দেখি অনেক দাম। এজন্য দুইটা ডিম নিয়েছি। বাসায় আরও দু’জন বন্ধু আসবে। এই দুইটা ডিমই সবাই মিলে খাবো।
অফিস বন্ধ থাকায় স্ত্রীকে নিয়ে বাজার করতে এসেছেন মেজবাহ। তিনি বলেন, একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করি। বাবা-মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ধানমণ্ডি থাকি। মাসে আয় ২০ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া দিলে কিছুই থাকে না। নিজেরা না খেলেও সন্তানদের জন্য প্রতিদিনের খাবারে ডিম রাখতে হয়। ডিম ছাড়া ওরা কিছু খেতে চায় না। গত কয়েকদিন থেকে বাড়তি দামে ডিম কিনতে হচ্ছে। সবকিছুর দাম ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।
হোস্টেলে থাকেন রোকেয়া। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি বলেন, হোস্টেলে খাবারের ব্যবস্থা আছে। ডিম আমাকে বাড়তি কিনে রাখতে হয়। যখন হোস্টেলের খাবার পেতে লেট হয় তখন নিজেই ভেজে খেতে পারি। ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপদে পড়তে হয়েছে।
তালতলা বাজারে ডিম কিনতে আসা আফজাল হোসেন বলেন, ডাক্তার আমার ছেলেকে প্রতিদিন একটা করে ডিম খেতে বলেছে। কারণ ওর আমিষের স্বল্পতা রয়েছে। এজন্য ডিম কিনতে হচ্ছে। তবে ডিমের দাম অনেক বেড়ে গেছে। ১০০ টাকা মূল্যের ডিম এখন ১৩৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অন্যান্য জিনিস কিনতেই যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানে ডিমের দাম বাড়ায় আরও সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছি।