স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধণের ‘ক্ষণ গণনা’ এবং প্রতিক্ষার দিন শেষ হয়ে আসছে। বহুল প্রতীক্ষিত এই সেতু আগামীকাল সকাল ১০ টায় উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নিয়ে পদ্মা সেতুর দুই পাড়সহ উৎসব বিরাজ করছে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায়। সর্বোত্রই সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর মাদারীপুরের কাঠালবাড়ি ইউনিয়নের বাংলাবাজার ঘাটে জনসভায় যোগ দেবেন। বাংলাবাজার ঘাটের তিন কিলোমিটার জুড়ে আলোকসজ্জা করা হয়েছে ইতোমধ্যে। এছাড়া ওই অঞ্চলের জেলাগুলোতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ব্যানার, ফেস্টুন করেছেন এবং রাস্তার উপরে তোরণ নির্মাণ করেছেন। প্রায় দশ লাখ লোকের জনসমাগম হবে বলে আশা করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। লোকসমাগম বাড়াতে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিরা। পদ্মা সেতু নির্মান করা চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে সেতুটি বুঝিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাবাজার ঘাটে জনসভার মঞ্চ করা হয়েছে পদ্মা সেতুর আদলে। এগারোটি পিলারের ওপর দশটি স্প্যান বসিয়ে পদ্মা সেতুর আদলেই ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪০ ফুট প্রস্থের বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। মঞ্চের ঠিক সামনে পানিতে ভাসমান বিশাল আকৃতির একটি নৌকা। দেখে মনে হবে পদ্মা সেতুর পাশ দিয়ে বড় একটি নৌকা চলছে। নিরাপত্তার জন্য মঞ্চের ভেতরে ও বাইরে বসানো হয়েছে ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার। থাকবে দেড় শতাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা। র্যাব, পুলিশ, সেনা সদস্য, এসএসএফসহ নানা বাহিনীও তৎপর। এটি ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে রূপ নেবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। স্বপ্নের সেতুর উদ্বোধনী মঞ্চে থাকবেন ৪১ জন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও মঞ্চে থাকবেন আওয়ামী লীগের পাঁচজন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের ২১ জন নেতা। বাকি ১৫ জন মন্ত্রিসভার সদস্য, দলীয় এমপি এবং দক্ষিণাঞ্চলের জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা।
পদ্মা সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সমাবেশ ঘিরে চলছে এলাহি কারবার। আগত লোকজনের জন্য ৫০০ অস্থায়ী শৌচাগার, ভিআইপিদের জন্য আরো ২২টি শৌচাগার, সুপেয় পানির লাইন, ৩টি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল, নারীদের আলাদা বসার ব্যবস্থা, প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার আয়তনের সভাস্থলে দূরের দর্শনার্থীদের জন্য ২৬টি এলইডি মনিটর, ৫০০ মাইকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া নদীপথে আসা মানুষের জন্য ২০টি পন্টুন তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়াও মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভ্রাম্যমাণ মোবাইল টাওয়ার নির্মাণ করছে।
এদিকে গত বুধবার পদ্মা সেতুর শতভাগ নির্মাণ কাজ শেষ করে আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুর দায়িত্ব প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়েছেন চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। গত মঙ্গলবার প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সেতুর সব কাজ বুঝে নিয়ে ঠিকাদারকে টেকিং ওভার সার্টিফিকেট দেয়। গত বুধবার ঠিকাদারের প্রকল্প ব্যবস্থাপক তাতে সই করার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়।
পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের জানিয়েছেন, মূল সেতু, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া, জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনসহ ছয়টি ভাগে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ হয়েছে। ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুর কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (এমবিইসি)। আগামীকাল পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে আরও এক বছর। ২০২৩ সালের ৩০ জুন এই প্রকল্প শেষ হবে। এই এক বছরের মধ্যে নির্মাণ কাজের কোন ত্রæটি থাকলে তা নিজ দায়িত্বে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেরামত বা পুনর্নির্মাণ করে দেবে।
এদিকে পদ্মা সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মাওয়া প্রান্তের সুধী সমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে দেশের রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে।
সমাবেশটিকে ঐতিহাসিক সমাবেশ করার লক্ষ্যে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। দক্ষিণের ২১ জেলা থেকে নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে আসবেন। প্রায় দশ লাখ লোকের জনসমাগম হবে বলে ধারণা করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
জনসভার মঞ্চ তৈরির কাজ করছে ক্যানভাস বাংলাদেশ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। জনসভাস্থলের দুই বর্গকিলোমিটার জায়গা তত্তাবধানের দায়িত্ব পেয়েছে পিয়ারু সরদার অ্যান্ড সন্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান। মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন জানান, প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে জনসভায় ১০ লাখ মানুষের সমাগম হবে। তাদের সব ধরনের সুবিধা দিতে জেলা প্রশাসন প্রস্তুতি নিয়েছে। এ ছাড়া ২০ শয্যার একটি এবং ১০ শয্যার আরও দুটি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্র খোলা হয়েছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও থাকবে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা। জরুরি স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার জন্য পুনর্বাসন এলাকায় থাকা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো ব্যবহার করা হবে।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে থাকবে একটি একক রেলপথ।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতু নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর ২০১৭ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুতে বসে প্রথম স্প্যান। সেই থেকে তিন বছর দুই মাস ১০ দিনে বা মোট ১১৬৭ দিন পর ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সেতুর সব স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পুরো পদ্মা সেতু। তিন হাজার ৬০০ টন ধারণ ক্ষমতার ‘তিয়ান-ই’ ভাসমান ক্রেন দিয়ে স্প্যানগুলো বসানো হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রয়োজন হয় দুই হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে র্যাব।
২০১৪ সালের ১৮ জুন মূল সেতু নির্মাণে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। আর নদীশাসনের জন্য চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে।
টোল : ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর টোল নির্ধারিত হয়েছে। মোটরসাইকেল এবং বড় বাস ছাড়াও মাঝারি ধরনের বাসের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার টাকা, কার ও জিপের ৭৫০ টাকা, মাইক্রো বাস ১৩০০ টাকা এবং মিনিবাসের (৩১ সিট বা তার কম) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪০০ টাকা। বর্তমানে পদ্মা নদী পার হতে ফেরিতে যানবাহনভেদে ভাড়া দিতে হয় ৭০ থেকে ৩ হাজার ৯৪০ টাকা। পদ্মা সেতুতে যানবাহনভেদে টোল দিতে হবে ১০০ থেকে ৬ হাজার টাকার বেশি। এর মধ্যে মোটর সাইকেল ১০০ টাকা ( ফেরিতে ৭০ টাকা), কার ও জিপের টোল ৭৫০ টাকা (ফেরিতে ৫০০ টাকা), বড় বাসে ২ হাজার ৪০০ টাকা (ফেরিতে ১ হাজার ৫৮০ টাকা), মাঝারি ট্রাকে ২ হাজার ৮০০ টাকা (ফেরিতে ১ হাজার ৮৫০ টাকা), চার এক্সেল টেইলারের ৬ হাজার টাকা।
সেতুর টোল আদায়কারী ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পেয়েছে কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন (কেইসি) ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। এর মধ্যে এমবিইসি বর্তমানে মূল সেতু নির্মাণকাজ এবং কেইসি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। আগামী পাঁচ বছরের জন্য এই দুটি প্রতিষ্ঠান টোল আদায়, সেতু ও সেতুর দুই প্রান্তে যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতি চালু এবং সেতু ও নদীশাসনের কাজ রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এর জন্য পাঁচ বছরে তাদের দিতে হবে ৬৯৩ কোটি টাকা।
এ পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হওয়ার মধ্যেই তিনটি বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলেছে পদ্মা সেতু। একটি হল- পদ্মা সেতুর পাইলিং। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীলরা বলছেন, পদ্মা সেতুুর খুঁটির নিচে সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীরে স্টিলের পাইল বসানো হয়েছে। এসব পাইল তিন মিটার ব্যাসার্ধের। বিশ্বে এখনও পর্যন্ত কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে পাইলিং হয়নি এবং মোটা পাইল বসানো হয়নি।
দ্বিতীয় রেকর্ড হল, ভূমিকম্প থেকে পদ্মা সেতুকে টিকাতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ লাগানো হয়েছে। যেই বিয়ারিংয়ের সক্ষমতা ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকতে পারবে পদ্মা সেতু। আর তৃতীয় রেকর্ড হল, নদীশাসন। নদীশাসনে চীনের ঠিকাদার সিনোহাইড্রো কর্পোরেশনের সঙ্গে ১১০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়েছে। এর আগে নদীশাসনে এককভাবে এত বড় দরপত্র বিশ্বে আর হয়নি। এ ছাড়া পদ্মা সেতুতে পাইলিং ও খুঁটির কিছু অংশে অতি মিহি (মাইক্রোফাইন) সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। এসব সিমেন্ট অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা হয়েছে। এ ধরনের অতি মিহি সিমেন্ট সাধারণত ব্যবহার করা হয় না।
আয় থেকে ঋণের টাকা পরিশোধ : নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হলেও এর ব্যয়ের টাকা ঋণ হিসেবে সেতু কর্তৃপক্ষকে দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পদ্মা সেতুর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সেতু কর্তৃপক্ষ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ নিজেদের আয়ে চলবে প্রতিষ্ঠানটি। পদ্মা সেতুর জন্য নেওয়া ঋণ ১ শতাংশ সুদসহ ৩৫ বছরে ফেরত দিতে হবে সেতু কর্তৃপক্ষকে। এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকারের ঋণ মওকুফ তহবিলের অর্থ ৩০০ কোটি টাকা। এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। ফলে প্রায় ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়কে ফেরত দিতে হবে। এর সঙ্গে বাড়তি ১ শতাংশ হারে সুদ ধরলে মোট পরিশোধ করতে হবে ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা।