কয়েকদিন পর উদযাপিত হবে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল-ফিতর। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীর মার্কেটগুলো ক্রেতা-বিক্রেতার পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে। উৎসবের আমেজে পরিবারের কেনাকাটায় মধ্যরাত পর্যন্ত ক্রেতারা থাকেন মার্কেটে। বিক্রেতারাও বছরের লোকসান কাটিয়ে উঠেন এ সময়ে। তবে গত ২ বছর করোনার কবলে পড়েছিল বিশ্ব। এর প্রভাবে আমাদের দেশের মার্কেটগুলোতে বেচা-বিক্রি ছিল না আশানুররূপ। এখন করোনা থেকে অনেকটাই উত্তরণ ঘটেছে। এরই মধ্যে আবারও এসেছে রমজান। এবারের ঈদ বাজারে গত দুই বছরের লোকসান পোষানোর টার্গেট রয়েছে বিক্রেতাদের। তবে এখনও রাজধানীর সব মার্কেটে ও ফ্যাশন হাউজগুলোতে আশানুরূপ ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। এ বছর বড় বাজেট নিয়ে ঈদ বাজারে ব্যবসা শুরু করলেও ক্রেতা না থাকায় চিন্তার ভাঁজ পড়ছে বিক্রেতাদের কপালে। তবুও রাজধানীর ব্যবসায়ীদের আশা ১৫ রমজানের পরই ভালো বিক্রি শুরু হবে। এদিকে গরমে সুতি কাপড়ে ঝোঁক থাকলেও ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর অভিজাত শপিংমলগুলোতে বিদেশি পোশাকের কালেকশনই বেশি। অভিজাত মার্কেটে মেয়েদের পোশাকের ক্রেতা চাহিদার শীর্ষে ভারতীয় শারারা, গারারা অথবা পাকিস্তানি ওয়ান পিস। মানভেদে একেকটি ড্রেস বিক্রি হচ্ছে ৫০ হাজার টাকায়ও। তবে রাজধানীর কয়েকটি মার্কেট ছাড়া বেচাকেনা এখনো জমে ওঠেনি বলছেন বিক্রেতারা।
বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, এসব জায়গায় পোশাকে নতুনত্বের সঙ্গে দামের তারতম্য রয়েছে। প্রতিটি পোশাকেরই দাম কিছুটা বেড়েছে। এবারের ঈদ আয়োজনে রয়েছেÑ শিশুদের শার্ট, ফতুয়া, শর্ট সøীভ, ফুল সøীভ, লং প্যান্ট, কোয়ার্টার প্যান্ট ও বিভিন্ন রংয়ের পাঞ্জাবি। এছাড়া মেয়ে শিশুদের জন্য রয়েছেÑ ফ্রক, পার্টি ফ্রক, ফ্যাশন টপস, থ্রি পিস, জাম্প স্যুট, নীমা সেট, টপ বটম সেট, লং ও শর্ট সøীভ শার্ট, পলো টি-শার্ট ও কার্গো। এসব পোশাক বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।
পুরুষের জন্য রয়েছেÑ হালকা ও টেকসই ফেব্রিকের তৈরি বিভিন্ন রংয়ের পাঞ্জাবি কালেকশন, শার্ট, টি-শার্ট, ইজি কেয়ার শার্ট, পাজামা, ডেনিম প্যান্টস, কাইতেকি প্যান্টস, জিন্স ও গ্যাবাডিং।
আর মেয়েদের জন্য রয়েছেÑ থ্রি পিস, টু পিস, কাজ করা জর্জেট কামিজ, ভিসকস কামিজ, বিভিন্ন রংয়ের প্রিন্ট লং শার্ট, টপস, টিউনিকস, কামিজের জন্য রয়েছে এমব্রয়ডারি স্ক্যান্টস, পালাজ্জো ও লেগিংস। এসব পোশাক পাওয়া যাচ্ছে ৪৫০ থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যে। এছাড়া মেয়েদের নানা কালেকশনের বোরকা পাওয়া যাচ্ছে ৬৫০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। তবে মার্কেটভেদে দামে তারতম্য রয়েছে।
এদিকে স্টাইলিশ ফ্যাশনে সেলাই আর নজরকাড়া কারুকার্য, এমন পোশাকে ভরা রাজধানীর অভিজাত শপিংমলগুলো। ঈদের আনন্দে উচ্চবিত্তের আকর্ষণ জর্জেট কাপড়ের তৈরি ভারতীয় শারারা, গারারার মতো দামি পোশাক। সাধ্যের মধ্যে নিজের ও স্বজনদের জন্য কিনছেন অনেকে। ঈদে কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কালেকশন ভালো হলেও গতবারের থেকে এবার কাপড়ের দাম একটু বেশি।
ক্রেতাদের চাহিদা মাথায় রেখেই এবারের ঈদ কালেকশন সাজানো হয়েছে, জানান বিক্রেতারা। ভারতীয় পোশাকের পাশাপাশি পাকিস্তানি জর্জেটের ওয়ান পিসও চলছে বেশ। ওয়ান পিসের এসব পোশাক ১ হাজার ৫০০ থেকে শুরু হলেও ভারতীয় সারারা বিক্রি হচ্ছে ১২ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকায়। অন্য বছরের তুলনায় এবার দাম বেশি বলছেন ক্রেতারা। স্বীকার করছেন বিক্রেতারাও। শবেবরাতের পর থেকে রাজধানীর গুলশান-বনানী এলাকায় ঈদ শপিং শুরু হলেও গতকাল ১৩ রমজানেও বেচাকেনা জমে ওঠেনি বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে গতকাল দেখা গেছে, ঈদুল ফিতর ঘিরে রাজধানীর অন্যতম বিপণিবিতান নিউমার্কেট ও এর আশপাশের মার্কেটগুলো ক্রেতা-দর্শণার্থীর ভিড়ে জমজমাট। মহামারির কারণে দুই বছর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা আশা করছেন ভালো ব্যবসা করে ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন। শুক্রবার বন্ধের দিন নিউমার্কেটে ছিল ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। ছুটির দিন ও রমজানের মাঝামাঝি সময়ের কারণে রাজধানীর অন্যতম এই মার্কেটে দেখা যায় ক্রেতাদের ভিড়। সব বয়সি ক্রেতারা এই মার্কেট থেকে পছন্দ মতো সামগ্রী কিনছেন। প্রায় সবার হাতেই ছিল কাপড় ও জুতার ব্যাগ।
আবার তরুণীরা নিজের জন্য থ্রিপিছ কিনলেও বাসার মুরুব্বিদের জন্য কিনছেন শাড়ি। পোশাকের দোকানের পাশাপাশি তৈজসপত্রসহ গৃহস্থালি সমাগ্রির দোকানেও ক্রেতার ভিড় দেখা গেছে। অন্যদিকে চাঁদনি চক, গাউসিয়া, ধানমন্ডি হকার্সসহ মার্কেটগুলোতে কিশোরী-তরুণীদের ভিড় ছিল লক্ষ্যণীয়। এই মার্কেটগুলোতে বিক্রি হয় মেয়েদের নানা পোশাক। মহামারি করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় মানুষের মধ্যে ভীতি কেটেছে। তাই সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা শুরু করেছেন। গাউছিয়া, চাঁদনী চক আর নিউমার্কেটে সব বয়সি নারীই ভিড় জমিয়েছেন। তবে এর মধ্যে থান কাপড়, শাড়ি আর অলঙ্কারের দোকানেই ক্রেতাদের ভিড় সবচেয়ে বেশি। তবে সবচেয়ে বেশি ভিড় লক্ষ্য করা গেছে নিউমার্কেটের সামনের ওভারব্রিজের ফুটপাথ এলাকায়। এ এলাকার ফুটপাথগুলোতে ছোট ছোট কিছু দোকান বা ভ্রাম্যমাণ দোকানে পছন্দের জিনিসপত্র কেনার জন্য সাধারণ লোকজনকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখা যায়। এখানে দেড়শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় পাঞ্জাবি পাওয়া যাচ্ছে।
এ এলাকার বিভিন্ন মার্কেটের শোরুম ও দোকানদাররা অনলাইনে প্রচারণা ও অফার দেয়ার কারণে এসব দোকানগুলোতে নারী-পুরুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। অনেক মধ্যবয়সি তরুণীরা আগের দিন অনলাইনে পণ্যের অফারের বিবরণ দেখে ছুটে এসেছেন তার কাক্সিক্ষত পণ্যটি কিনে নিতে। অনেকেই আবার ভিড়ের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন তার পণ্যটির জন্য। কোন কোন দোকানের বিক্রেতারা পর্যাপ্ত পরিমাণ পণ্যের সরবরাহ আছে বলে ক্রেতাদের আশ্বস্ত করছেন। এছাড়াও এই মার্কেটগুলোতে ঈদকে সামনে রেখে কসমেটিকস, জুয়েলারি, ইমিটেশন গোল্ড, জুতা-স্যান্ডেলসহ অন্যান্য পণ্যের দোকানের বাইরেও পসরা সাজিয়েছেন বিক্রেতারা।
নিউমার্কেটের রাসেল নামের এক বিক্রেতা বলেন, রমজনের শুরুতে তেমন ক্রেতাদের আনাগোনা ছিল না। এখন প্রতিদিন ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্রেতাদের উপস্থিতিতে তারা সন্তুষ্ট। গতকাল ছুটির দিন থাকায় অন্য যেকোনো দিনের চেয়ে বিক্রি হয়েছে বেশি। চাঁদরাত পর্যন্ত তাদের ভালো বিক্রির আশা করছেন।
নিউমার্কেটে থ্রিপিছ কিনতে আসা নাজমুন্নাহার বলেন, গত কয়েকদিন ধরে পছন্দের জামাটি অনলাইনে দেখে কিনতে এসেছি। এখানে এসে লোকজনের ভিড়ের কারণে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে পণ্যটি হাতে পেলাম। এখন ভালো লাগছে। এখানকার বেশিরভাগ ক্রেতাই অনলাইনে পণ্য পছন্দ করে কিনতে আসেন। তবে দেখা যাচ্ছে আগের তুলনায় ক্রেতা দিন দিন বাড়ছে।
বিক্রি কেমন এ নিয়ে কথা হয় রাজধানী মার্কেটের ইতি ফ্যাশনের ম্যানেজার মো. জনির সঙ্গে। তিনি বলেন, গত দুই বছর করোনার কারণে বিক্রি হয়নি। এবার পুরো প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি, বিক্রি ভালো হবে। কিন্তু এখনও বিক্রি জমে উঠেনি। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের আবারও আশাহত হতে হবে। একই কথা বললেন কসমেটিকস ও ইমিটেশন ব্যবসায়ী লেডিস বিউটির ম্যানেজার মুন্না। তিনি বলেন, এখনও ক্রেতা আসেনি। যা বিক্রি হচ্ছে তা সপ্তাহের অন্যান্য দিনের মতোই। মনে হচ্ছে এবারও লোকসান গুনতে হবে ব্যবসায়ীদের। তবে ক্রেতা না এলেও একেবারে আশা ছাড়ছেন না অনেক ব্যবসায়ী।
রাজধানী সুপার মার্কেটের বিক্রেতারা বলছেন, এখনও বিক্রি জমে উঠেনি। অনেক আশা নিয়ে দোকানে মালামাল উঠালেও তারা ক্রেতা পাচ্ছেন না। এভাবে চললে গত দুই ঈদের মতো এবারও তাদের আনন্দ ফিকে হয়ে যাবে। তবে এখনও তারা আশা করছেন যে বিক্রি জমে উঠবে।
একই মার্কেটের স্বর্ণালিপি জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী জাকির হোসেন বলেন, এ বছর দ্রব্যমূল্যের দাম প্রচুর। অনেকেই করোনার অর্থসঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এসব কারণে এখনও তারা মার্কেটমুখী হয়নি। তবে ১৫ রোজার পর থেকে ক্রেতার দেখা পাওয়া যাবে বলে আশা করি। প্রতি বছর রোজার মাঝামাঝিতে কেনাকাটা জমে উঠে। তাই এবারও জমবে বলে আশা করি।
করোনার ধাক্কা কাটিয়ে জমজমাট দেশের সবচেয়ে বড় দেশীয় কাপড়ের বাজার নরসিংদীর শেখেরচর বাবুরহাট। সারাদেশে এখান থেকেই কাপড় নিয়ে যায় দোকানীরা। ঈদ সামনে তাই করোনার কারণে বিগত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার আশা পাইকারি বিক্রেতাদের। তবে সুতার দাম বেশি হওয়ায় বেড়েছে কাপড়ের দাম। এতে কেনাকাটায় প্রভাব পড়তে পারে বলে দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা। সূত্র মতে, রোজার শুরু থেকেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায় মুখর দেশের বৃহত্তম পাইকারি কাপড়ের বাজার নরসিংদীর শেখেরচর বাবুরহাট। শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিস, শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি ও থান কাপড়সহ দেশীয় তৈরি উন্নতমানের কাপড় পাওয়ায় এ বাজারের কদর সবচেয়ে বেশি। দেশীয় বস্ত্রের প্রায় ৭০ ভাগ কাপড়ের চাহিদা পূরণ হয় এ বাজার থেকেই। ঈদ উপলক্ষে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী দোকানগুলোতে নিত্যনতুন ডিজাইনের পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। তবে এ বছর হাটে আসা কাপড়ের দাম বেশি বলে অভিযোগ ক্রেতাদের। করোনা মহামারিতে দু’বছর লাভের মুখ দেখেননি ব্যবসায়ীরা। চীন ও ভারতীয় সুতার দাম বাড়ায় বাজারে এর প্রভাব পড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
ঈদ ঘিরে এ বছর দেড় থেকে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি বেচাকেনা হবে, এমন আশাবাদ প্রকাশ করেন নরসিংদীর শেখেরচর-বাবুরহাট বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া। এ বাজারে ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার দোকান রয়েছে। সপ্তাহের বৃহস্পতি থেকে রোববার পর্যন্ত টানা চারদিন চলে হাটের বেচাকেনা।
এদিকে প্রতি বছর রোজার শুরুতে জমে উঠলেও এবার এখনো ঈদের কেনাকাটার ব্যস্ততা শুরু হয়নি রাজধানীর মিরপুরের বেনারসি পল্লিতে। গতকাল মিরপুর বেনারসি পল্লি ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ক্রেতাশূন্য বেশিরভাগ দোকান। দু’একটায় ক্রেতার দেখা মিললেও নেই আশানুরূপ বেচাকেনা। রমজানের ১৩ দিন পার হলেও আশানুরূপ বিক্রি না হওয়ায় হতাশ ব্যবসায়ীরা। বেনারসি পল্লীর হানিফ সিল্কের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হানিফ বলেন, বেচাকেনা খুব খারাপ। ২৫ বছরের ইতিহাসে এমন খারাপ বেচাকেনা হয়নি। তবে আশাবাদি সামনে বিক্রি বাড়বে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, করোনার আগে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে পোশাক, জুতা ও অন্যান্য সাজসজ্জার প্রসাধনী বিক্রি হতো ৫ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকার। গত দুই বছরে করোনার কারণে মানুষের আয় রোজগারও কমেছে। মানুষের মনে স্বস্তি নেই। বৈশাখ আর ঈদ কাছাকাছি সময়ে পড়ে যাওয়ায় অনেকে শুধু ঈদের পোশাক কিনবে। এ কারণে বৈশাখের বাজার তেমন জমেনি। তবে আশাবাদী ঈদ বাজার জমবে।