নৌকার সঙ্গে টেবিলঘড়ি-ঘোড়ার লড়াই, পর্যবেক্ষণে সব কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা, নিরাপত্তার চাদরে কুমিল্লা
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ভোট আজ। একজন মেয়র ও ৩৬ জন কাউন্সিলর নির্বাচনে ভোট দেবেন শহরের প্রায় সোয়া ২ লাখ ভোটার। দুই সপ্তাহের প্রচারণা শেষে ভোটের দিনের জন্য প্রস্তুত প্রার্থীরা। মোড়ে মোড়ে নিরাপত্তা জোরদার করে প্রস্তুত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। তবে পুরো দেশের মূল দৃষ্টি নির্বাচন কমিশনের দিকে। সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে গঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রথম পরীক্ষা হবে আজ। এ নির্বাচন কমিশনের আওতায় কুমিল্লা সিটিতে হচ্ছে প্রথম ভোট। অন্যতম নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার দৃঢ়বিশ্বাস, ভবিষ্যতে উদাহরণ দেওয়ার মতো একটি নির্বাচন কুমিল্লায় হবে।’
অন্যদিকে কুমিল্লার নগরপিতা কে হবেন, তার ওপর স্থানীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ হিসাব-নিকাশ দেখছেন কুমিল্লাবাসী। টানা দুই মেয়াদে থাকা মনিরুল হক সাক্কু তাঁর টেবিলঘড়ি প্রতীক নিয়ে কি হ্যাটট্রিক করে মেয়রের আসনে বসবেন, নাকি নতুন কেউ আসবেন তা নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। মূল আলোচনায় আছেন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। ছেড়ে কথা বলছেন না স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের নিজাম উদ্দিন কায়সারও। অবশ্য মেয়রের প্রার্থী তালিকায় আছেন হাতপাখা প্রতীক নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা রাশেদুল ইসলাম ও হরিণ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান বাবুল। ভোট গ্রহণের জন্য গতকাল সকালে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পাঠানো হয়েছে। কুমিল্লা জিলা স্কুলের শহীদ আবু জাহিদ মিলনায়তন থেকে বিতরণ করা হয় ইভিএম। ট্রাকে করে বিশেষ নিরাপত্তায় ইভিএমসহ মালামাল নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রগুলোয। এবার ১০৫ কেন্দ্রে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন ভোটাররা। বুথ থাকবে ৬৪০টি।
মালামাল বিতরণের সময় এ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সুষ্ঠু ভোট করায় বদ্ধপরিকর। পুলিশ প্রশাসনের সার্কুলার অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রতি কেন্দ্রেই পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ, আনসার রয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় চেক পয়েন্ট করা হয়েছে যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। আমি আশাবাদী, একটি ভালো নির্বাচন হবে।’
গতকাল কুমিল্লার ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘ভোট গ্রহণের দিন কর্তব্যরত অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য গাফিলতি বা অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘দায়িত্বরত অবস্থায় কেউ গাফিলতি ও অনিয়ম করলে ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অতীতেও আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যারা কাজ করেছেন, তাদের শাস্তি দিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে ৩ হাজার ৬০৮ জন পুলিশ সদস্য মাঠে থাকবেন। তারা কুমিল্লা সিটির ২৭ ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করবেন। নির্বাচনে কোনো ধরনের ঝামেলা সহ্য করা হবে না।’
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, আজ সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ করা হবে। ভোট পর্যবেক্ষণে কেন্দ্রে কেন্দ্রে থাকছে সিসি ক্যামেরা। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা থেকে মনিটরিং করবেন নির্বাচন কমিশনাররা। নির্বাচন ঘিরে নগরজুড়েই চলছে উৎসবের আমেজ। অপেক্ষায় ভোটাররা। এ নগরীর ২৭ ওয়ার্ডে মোট ভোটার ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন। নারী ১ লাখ ১৭ হাজার ৯২ ও পুরুষ ১ লাখ ১২ হাজার ৮২৬ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার দুজন। ১০৮ জন সাধারণ ও ৩৮ জন সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থী। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন দেশি সাত পর্যবেক্ষক সংস্থা ও গণমাধ্যমকর্মীরা। এরই মধ্যে ভোট গ্রহণের সব প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন (্ইসি)। ভোট গ্রহণ ও ভোটারদের নিরাপত্তায় মাঠে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় সাড়ে ৩ হাজার সদস্য।
নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী সোমবার রাত ১২টা থেকে নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেছে। ভোটারদের আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রেও থাকছে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা। ভোটাধিকার প্রয়োগে কোনো ভোটারকে কেন্দ্রে আসা-যাওয়ার পথে কেউ বাধা দিলে বা ভয়ভীতি, শক্তি প্রদর্শন করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ভোট উপলক্ষে এ সিটিতে আজ সাধারণ ছুটি থাকছে না। তবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
চার স্তরের নিরাপত্তাবলয় : নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে চার স্তরের নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মাঠে নেমেছে ২২ প্লাটুন বিজিবি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিজিবির সঙ্গে মাঠে রয়েছেন র্যাব-পুলিশের সদস্যরা। কেউ কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করলে অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। ভোট গ্রহণের আগের দুই দিন, ভোট গ্রহণের দিন ও ভোটের পর দিন- মোট চার দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সিটি এলাকায় থাকবে। তবে আনসার বাহিনী মোট পাঁচ দিন নিয়োজিত থাকবে। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের জন্য র্যাবের রিজার্ভ টিম সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকবে। মোবাইল স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত প্রতিটি টিমে বিশেষ করে বিজিবির টহল দলে একজন করে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৩ থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত মোট ২৭ জন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া ১৩ থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত নয়জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নির্বাচনী অপরাধ বিচারের দায়িত্বে থাকবেন। নির্বাচন উপলক্ষে গতকাল ১৪ জুন মধ্যরাত থেকে ভোটের দিন রাত ১২টা পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। ১৩ জুন মধ্যরাত থেকে ১৬ জুন সকাল ৬টা পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকছে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, নির্বাচনী এজেন্ট, দেশি/বিদেশি পর্যবেক্ষক, গণমাধ্যমকর্মী, নির্বাচনে বৈধ পরিদর্শক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, জরুরি সেবাকাজে মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না। এ ছাড়া ১৩ জুন সকাল ৬টা থেকে ১৭ জুন রাত ১২টা পর্যন্ত আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন, আগ্নেয়াস্ত্রসহ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। ভোট কেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন করা যাবে না।
শেষ মুহূর্তে টাকার ছাড়াছড়ি : শেষ মুহূর্তে টাকা ছড়ানোর অভিযোগও উঠেছে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। বিত্তশালী প্রার্থীরা ভোট কিনতে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ধরনা দিচ্ছেন। নগদ অর্থ ছাড়াও ভোটারদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন উপহারসামগ্রী।
(১) সিটি নির্বাচনের কারণে কুমিল্লায় গতকাল যানবাহনে তল্লাশি পুলিশের (২) ভোটের সরঞ্জাম সরবরাহ (৩) কেন্দ্রে বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা