1. rashidarita21@gmail.com : bastobchitro :
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ধস | Bastob Chitro24
শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ পূর্বাহ্ন

মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ধস

ঢাকা অফিস
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২৯ আগস্ট, ২০২২

ভবিষ্যতে বিনিয়োগ কমবে, অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে : ড. আহসান এইচ মনসুর

দেশে নতুন বিনিয়োগের অন্যতম নির্দেশক মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি এক ধাক্কায় তলানিতে নেমে এসেছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। যদিও আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া নানামুখী পদক্ষেপের সুফল মিলতে শুরু করেছে। কমছে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ। আপাতদৃষ্টিতে এতে সরকার তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক পণ্য আমদানির সবশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য মাত্র ২২ কোটি ১১ লাখ ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খুলেছেন বাংলাদেশের শিল্পদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ৫৬ শতাংশ কম। ২০২১ সালের জুলাই মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির দ্বিগুণেরও বেশি ৫০ কোটি ডলারের এলসি খুলেছিলেন শিল্পেদ্যোক্তারা। এর অর্থ হচ্ছে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা কলকারখানা স্থাপনে আগের চেয়ে যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। এতে দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদন ‘ধস’ নামার একটা অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছে। কারখানা সম্প্রসারণ হোক অথবা নতুন কারখানা স্থাপন হোক, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমান এটাই হলো তার পরিষ্কার ইঙ্গিত।

শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়ার অর্থ হলো দেশে নতুন শিল্প হচ্ছে না। বিনিয়োগ স্থবিরতা চলছে। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগবিমুখ হয়ে পড়ছেন। আর বিনিয়োগ কমে গেলে কর্মসংস্থানও কমে যায়। তাই পরিস্থিতি এমন হওয়াতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতি বছরে দেশের শ্রমবাজারে ২০ লাখেরও বেশি কর্মক্ষম লোক প্রবেশ করছে। তাদের জন্য বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান দরকার। কিন্তু নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হয়ে যদি বিদ্যমান শ্রমবাজার সঙ্কুচিত হয়, তাহলে বেকারত্বের হার বেড়ে যাবে।

টাকার বিপরীতে আমেরিকান মুদ্রা ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলেছেন, পণ্য আমদানির জন্য ব্যাংকগুলো ১১০ টাকার বেশি নিচ্ছে। এতে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। এত বেশি খরচ করে যন্ত্রপাতি আমদানি করে শিল্প স্থাপন করলে সেই শিল্প লাভজনক হবে কি-নাÑ তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। সে কারণেই সবাই মূলধনি যন্ত্রপাতি কমিয়ে দিয়েছেন বলে মনে করছেন তারা।
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন। অর্থাৎ শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, আগামী দিনগুলোতে দেশে শিল্প খাতে বিনিয়োগ কমবে। আর বিনিয়োগ কমা মানে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে না। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে না। সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, অন্য সব পণ্যের সঙ্গে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমবেÑ এটাই স্বাভাবিক। কেননা, ১১৪ টাকা দিয়ে ডলার কিনে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি করে শিল্প স্থাপন করলে, সেই কারখানা যখন উৎপাদনে যাবেÑ তা থেকে মুনাফা আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সে কারণেই উদ্যোক্তারা আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। এতে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ঠিক। কিন্তু লোকসান হতে পারেÑ এমন আশঙ্কা থেকে তো কোনো ব্যবসায়ী শিল্প স্থাপন করবে না।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেল এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির যে আবহ দেখা দিয়েছিল, তা কিছুটা হলেও হোঁচট খেয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতির গবেষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে (১২ মাস, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৬৪৬ কোটি ৩৭ লাখ (৬ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছিলেন উদ্যোক্তারা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। গত বছরের আগস্ট থেকে দেশে আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। টাকার বিপরীতে ডলারের দর অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে। এপ্রিল মাস থেকে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে একটার পর একটা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। যার সুফল জুন মাস থেকে পড়া শুরু করে। জুলাই মাসে তা ভালোভাবে দৃশ্যমান হয়েছে।

এদিকে দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচ লফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। যার চাপ পড়ে অর্থনীতিতে। আমদানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রফতানি ও রেমিট্যান্স না বাড়ায় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ১২ জুলাই ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। গত দেড় মাসে তা আরও কমে গত বৃহস্পতিবার ৩৯ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ৭৩৮ কোটি ২৬ লাখ (৭ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছিলেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা, যা ছিল ৯ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর আগের মে মাসে ৮২০ কোটি ডলারের এলসি খোলেন ব্যবসায়ীরা। এর অর্থ এক মাসের ব্যবধানে প্রায় ৮২ কোটি ডলার সাশ্রয় হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য আমদানির জন্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা মোট ৯ হাজার ২২৩ কোটি ৪৯ লাখ (৯২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৭০৩ কোটি ৭৪ লাখ (৬৭ দশমিক ০৩ বিলিয়ন) ডলার।

করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানি খাতে খরচ বাড়তে থাকে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ৫১৪ কোটি ৫৩ লাখ (৫ দশমিক ১৪ বিলিরয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়। আগস্টে তা এক লাফে ৪৫ দশমিক ২৩ শতাংশ বেড়ে ৭১৮ কোটি ৪১ লাখ ডলারে ওঠে। সেপ্টেম্বরে তা আরও বেড়ে ৭৭৭ কোটি ডলার দাঁড়ায়। অক্টোবরে এলসি খোলা হয় ৭৪২ কোটি ১৬ লাখ ডলারের। নভেম্বরে এলসি খোলা হয় ৮১০ কোটি ৬৯ লাখ (৮ দশমিক ১০ বিলিয়ন) ডলারের। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এক মাসে এলসি খোলার পরিমাণ ৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায় ওই মাসে। ডিসেম্বরে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৮৬৪ কোটি ৬২ লাখ ডলার। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ৮২৮ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের এলসি খোলেন ব্যবসায়ীরা। পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে অবশ্য কমে ৭১০ কোটি ডলারে নেমে আসে। ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিন হওয়ায় এলসি খোলার পরিমাণও কমেছিল বলে জানান ব্যাংকাররা। মার্চে ৮৯০ কোটি ২৬ লাখ ডলারের এলসি খোলেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা, যা ছিল এক মাসের হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি এলসি খোলার পরিমাণ। এপ্রিলে তা কমে ৮২৮ কোটি ৯৭ লাখ ডলারে নেমে আসে। মে মাসে এলসি খোলা হয় ৮২০ ডলারের। জুনে খোলা হয় ৭৩৮ কোটি ২৭ লাখ ডলারের এলসি। সর্বশেষ জুলাই মাসে তা আরও কমে ৫৬৯ কোটি ১০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ১০ শতাংশের মতো। এই মাসে ১৮৯ কোটি ১০ লাখ ডলারেরিএলসি খোলা হয়েছে। গত বছরের জুলাই মাসে খোলা হয়েছিল ২১০ কোটি ১৬ লাখ ডলার। জুলাইয়ে জ্বালানি তেল আমদানির এলসি খরচ বেড়েছে ৯৩ শতাংশ। গত বছরের জুলাই মাসে এলসি খোলা হয়েছিল ৫০ কোটি ৫৮ লাখ ডলারের। এই বছরের জুলাইয়ে খোলা হয়েছে ৯৭ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। অন্যদিকে খাদ্য আমদানির এলসি খোলা পরিমাণ বেড়েছে ২৪ শতাংশের মতো।

‘মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি না কমে অন্য সব পণ্যের এলসি কমলে খুব ভালো হতো’ এই মন্তব্য করে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি কমা মানে, ভবিষ্যতে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, একটি কঠিন সময় পার করছে গোটা বিশ্ব। আমরাও তার বাইরে নই। এই অবস্থায় ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। স্বাভাবিক কারণে ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছেন। বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হবে, তখন আবার আমদানি করবেন। কিন্তু কবে স্বাভাবিক হবে, সেটাই এখন বড় বিষয়।

তিনি বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে বাজারে ডলারের তীব্র সঙ্কট চলছে। ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিন যে ডলার বিক্রি করছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম; সরকারের আমদানি খরচই মিটছে না তাতে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো কোনো ডলার পাচ্ছে না। সে কারণেই তারা প্রবাসীদের কাছ থেকে বেশি দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। বাধ্য হয়ে এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি দর রাখছে। একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েই চলেছে। দুর্বল হচ্ছে টাকা। এখন যে করেই হোক, টাকাকে শক্তিশালী করতে হবে।

যদিও এরপরও সুসংবাদ হচ্ছে, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের ফলে আমদানি ব্যয় কমছে। রেমিট্যান্স বাড়ছে। এটা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। দেখা যাক কী হয়?

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
এই ওয়েবসাইটের লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
প্রযুক্তি সহায়তায়: রিহোস্ট বিডি