1. rashidarita21@gmail.com : bastobchitro :
মানুষখেকো লেভেল ক্রসিং | Bastob Chitro24
সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৭ অপরাহ্ন

মানুষখেকো লেভেল ক্রসিং

ঢাকা অফিস
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ৩১ জুলাই, ২০২২

আড়াই বছরে রেলক্রসিংয়ে ১১৬ দুর্ঘটনায় নিহত ২১৯ দেশ কত পিছিয়ে রয়েছে রেলপথের দুর্ঘটনাগুলো তার প্রমাণ : জি এম কাদের রেললাইনের আশপাশের সব এলাকাই ঝুঁকিপূর্ণ : অধ্যাপক ড. শামসুল হক

রেলওয়ের লেভেল ক্রসিং এখন হয়ে পড়েছে মানুষ খেকো। সারাদেশে হাজার হাজার অবৈধ ও বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে ঝরছে তাজা প্রাণ। পঙ্গুত্ববরণ করছেন অনেকে। দিন দিন নিরাপদ বাহনের তকমা হারাচ্ছে রেল। নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ডুবতে বসেছে রেলের সুনাম। রেলের ভিতরে বাইরে সবখানেই যেন সমস্যা। কালো বিড়াল ও হোয়াইট ইঁদুরের আক্রান্ত যেন দিন দিন ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০২০ থেকে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশের রেলক্রসিংসমূহে ১১৬টি দুর্ঘটনায় ২১৯ জন নিহত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু লেভেল ক্রসিংয়ের ওপর দায় চাপিয়ে লাভ নেই। লেভেল ক্রসিংয়ের দায়িত্বে থাকা মানুষকে দোষ দেয়ার বদলে মানুষের সচেতন হতে হবে। পথচারীদের সতর্কতা কমাতে পারে লেভেল ক্রসিংয়ের দুর্ঘটনা।

রেলের আইন অনুসারে লাইনের দুই পাশে ১০ ফুট করে মোট ২০ ফুট এলাকায় যেকোনো মানুষ প্রবেশ করলেই তা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। এমনকি ২০ ফুটের মধ্যে কোনো গবাদিপশু প্রবেশ করলেও তা আটকের মাধ্যমে বিক্রি করে রেলওয়ের কোষাগারে জমার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এসব আইন মানেন না কেউই। আবার আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। রাজধানীরসহ সারাদেশের রেললাইনের পাশে গড়ে উঠেছে বাজার। ট্রেন আসার আগ মুহূর্তে লাইনম্যান দুদিকে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা পারাপার বন্ধ করে দেন। কিন্তু ব্যারিকেডের নিচ দিয়ে কিংবা একটু দূরে লোহার বার তুলে ঢুকে পড়েন পথচারী এবং সাইকেল-মোটরসাইকেল চালকদের অনেকেই। দায়িত্বরত গেটম্যানরা বাঁশি বাজালেও তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। আর অনেক লেভেল ক্রসিং আছে যেখানে নেই কোন গেটম্যান অথবা নেই কোন প্রতিবন্ধকতা।

গত শুক্রবার চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হয় ১১ জন। মুহূর্তে আনন্দযাত্রা পরিণত হয় বিষাদে। তদন্তে কমিটি গঠন হয়। ৩ ঘণ্টা পর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়। আহত হয়েছেন আরো ছয়জন। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল লাইনের উপজেলার বড়তাকিয়া রেলক্রসিংয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী ট্রেন রেললাইনে উঠে পড়া মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা দিলে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।

এবিষয়ে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন গণমাধ্যমকে বলেন, মিরসরাইয়ের দুর্ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। এতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে গেলো, এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু এই দুর্ঘটনার জন্য কিভাবে কাকে দোষারোপ করবেন? আমি সবসময়ই বলছি নিরাপদ সড়কের দায়িত্ব সবার। কারো একার নয়, মানুষ যদি সচেতন না হয় তাহলে দুর্ঘটনা এড়ানো অসম্ভব। গেটম্যানতো রাখা হয়েছে রেলের নিরাপত্তার জন্য। কোনো যানবাহন যেনো রেলকে অনিরাপদ করতে না পারে সেটাই হলো মূল কনসেপ্ট। তিনি বলেন, গেটম্যান, দুর্ঘটনা, এ বিষয়গুলোতে রেলের ওপর এককভাবে দায় না দিয়ে যৌথভাবে নিতে হবে। এছাড়া সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ আমাদের প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার গেট রয়েছে। এর মধ্যে কতগুলো বৈধ আবার কতগুলো অবৈধ এটার ওপর প্রায়ই আমরা কথা বলছি। মর্মান্তিক এই ঘটনাটির জন্য আমি গেটম্যানকেই দোষারোপ করবো।
তিনি আরও বলেন, ঘটনাটির তদন্ত করার পর জানতে পারবো আসলে দায়ী কে? কিন্তু এই যে এতগুলো প্রাণ গেলো সেটা কি আর আমরা ফেরত পাবো। তাই বলছি, এমন দুর্ঘটনা যেন আর না ঘটতে পারে সেজন্য এর দায়-দায়িত্ব যৌথভাবে নিতে হবে। শুধু রেলের ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়াটা ঠিক হবে না।

জানা যায়, সারা দেশে রেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ৮৯ শতাংশই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে। রেলপথের ওপর দিয়ে কোথাও কোথাও সড়ক চলে গেছে। লেভেল ক্রসিং এগুলোকে বৈধ, অবৈধ, পাহারাদার আছে (ম্যানড), পাহারাদার নেই (আনম্যানড) এভাবে শ্রেণিবিন্যাস করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। যেসব ক্রসিংয়ে পাহারাদার আছেন, সেগুলোতে লোহার প্রতিবন্ধক থাকে। কখনো বাসের সঙ্গে, কখনো মাইক্রোবাসসহ অন্য যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটে। অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ছোট একটি সতর্কীকরণ নোটিস ঝুলিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় সারে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, দেশের দুই হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথে দুই হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিং আছে। এর মধ্যে এক হাজার ৪৯৫টি বৈধ ও এক হাজার ৩৬১টি অবৈধ। ৯৬১টি ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নেই। দেশে ৮২ শতাংশ ক্রসিং অনিরাপদ। ২০২০ থেকে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত লেভেল ক্রসিংয়ে আড়াই বছরে সারাদেশের লেভেল ক্রসিংয়ে ১১৬টি দুর্ঘটনায় ২১৯ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। বছর অনুযায়ী পরিসংখ্যানের পাশাপাশি দুর্ঘটনা এড়াতে বেশ কিছু সুপারিশও করেছে তারা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৩৮ দুর্ঘটনায় ৬৯ জন, ২০২১ সালে ৪৩ দুর্ঘটনায় ৭৬ জন, ২০২২ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত ৩৫ দুর্ঘটনায় ৭৪ জন মারা যান। সবশেষ গত শুক্রবার মীরসরাইয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান লেভেল ক্রসিং দুর্ঘটনার যেসব করণগুলো চিহ্নিত করেছেন তা হলো-অননুমোদিত ও অবৈধ বিবেচনা করে বহু সংখ্যক লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যান ও গেটবারের ব্যবস্থা না করা, বৈধ লেভেল ক্রসিংসমূহে গেটম্যানদের দায়িত্বে অবহেলা ও গেটম্যান হিসেবে লোকবলের সঙ্কট, যানবাহনের চালক ও সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতা ও অধৈর্য মানসিকতা, দুর্ঘটনায় দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া ও রেলপথ ব্যবস্থাপনায় আইনের শাসনের অভাব। দুর্ঘটনা এড়াতে তাদের সুপারিশসমূহ, সব রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান নিয়োগ ও উপযুক্ত গেটবারের ব্যবস্থা করা, লেভেল ক্রসিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার করা, জনবল সঙ্কট নিরসন করে রেলপথ ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করা, সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমে প্রচারণা চালানো।

সেভ দ্য রোড-এর তথ্য বলছে, মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়ায় রেল দুর্ঘটনায় নিহত ১১ জনের মৃত্যুসহ গত ৭ মাসে ছোট-বড় ১ হাজার ৫২টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৭৮ জন এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ১৭০ জন। গতকাল শনিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সংগঠনটি। এসব দুর্ঘটনার অধিকাংশই ঘটেছে গেটকিপারদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে।

সংগঠনটি জানায়, রেলের ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে অবৈধ ১ হাজার ৩৬১টি অর্থাৎ প্রায় ৪৮ শতাংশই অবৈধ। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ৩৩টি ক্রসিং কে বা কারা ব্যবহার করছে, তা কেউ জানে না। এছাড়া বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে ৬৩২টিতে গেটকিপার নেই। অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোয় যেমন গেটকিপার নেই, নেই কোনো সুরক্ষা সরঞ্জামও। ১ থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত রেলপথে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৬টি, এতে আহত হয়েছেন ৫২ জন, নিহত হয়েছেন ১৪ জন। ১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রেলপথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪১টি, এতে আহত হয়েছেন ১১১ জন, নিহত হয়েছেন ২৭ জন। ১ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটেছে ২২২টি, এতে আহত হয়েছেন ১৮৬ জন, নিহত হয়েছেন ৩১ জন।

১ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত রেলপথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ১১২টি, এতে আহত হয়েছেন ১৬৬ জন, নিহত হয়েছেন ৪২ জন। মে মাসে ২১২টি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ২২১ জন, নিহত হয়েছেন ২৩ জন। জুন মাসে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি, আহত হয়েছেন ১৭২ জন, নিহত হয়েছেন ১৭ জন এবং জুলাই মাসে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৪২টি। ঈদুল আজহার ঈদযাত্রাসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় জুলাইয়ে আহত হয়েছেন ২৩২ জন, নিহত হয়েছেন ২৪ জন। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি নিহতদের পরিবারকে কমপক্ষে ১০ লাখ এবং আহতদের সরকারি অর্থায়নে চিকিৎসার দাবি জানিয়েছেন সেভ দ্য রোডের নেতারা। একইসঙ্গে রেলওয়ের বর্তমান পরিস্থিতির উত্তরণে সেভ দ্য রোড-এর পক্ষ থেকে ৭টি সুপারিশ দেয়া হয়।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, দেশের প্রায় ৮২ ভাগ লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত। সারাবিশ্বে রেলপথে যাতায়াত নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হলেও বাংলাদেশে যেন মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরেও দেশের রেলপথ নিরাপদ হয়নি। রেলপথে এমন মৃত্যুর মিছিল মেনে নেয়া যায় না। আধুনিক যুগে রেলপথের দুর্ঘটনাগুলো প্রমাণ করে আমরা কতটা পিছিয়ে আছি। দেশের রেলপথ নিরাপদ করতে এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া জরুরি। অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতি বছর রেলপথে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। এসব ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও, প্রতিবেদন জানতে পারে না দেশের মানুষ। দুর্ঘটনা রোধে সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে তাও জানতে পারে না কেউ। রেল বিভাগের এমন অবহেলা ও অব্যবস্থাপনা দেখার যেন কেউ নেই। এসব লেভেল ক্রসিংয়ে পাহারাদার ও কোনো প্রতিবন্ধক নেই। তবে ১৮ ভাগ ক্রসিংয়ে পাহারাদার ও প্রতিবন্ধক থাকলেও সেখানেও অবহেলার অন্ত নেই। তাই প্রতিদিনই ঘটছে এমন দুর্ঘটনা। গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন।

মহানগর প্রভাতী ট্রেনের লোকোমাস্টার (চালক) জহিরুল হক খান বলেন, মাইক্রোবাসটি ২/৩ সেকেন্টের মধ্যেই রেল লাইনে উঠে পরে। সে সময় আমার আর কিছু করার ছিলো না। কারণ ট্রেনের গতি থামানোর জন্য নির্ধারিত দূরত্ব থাকে ৪৪০ গজ। ৪৪০ গজের আগেই থামাতে হবে। কিন্তু মাইক্রোবাসটি ২/৩ সেকেন্টের মধ্যেই রেল লাইনে উঠে পড়ে এতো কাছে থাকায় ইঞ্জিন এবং গাড়ির ব্রেক চেপেও থামানো সম্ভব হয়নি। গাড়ি যখন থামে আমি নেমে গিয়ে দেখি ততক্ষণে কতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে যে ছেলেগুলো মৃত্যুবরণ করেছে তারা সবাই আমার ছেলের বয়সী।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক ইনকিলাবকে বলেন, সড়কের সঙ্গে রেলের কোনো সমন্বয় নেই। শুধু যে লেভেল ক্রসিং ঝুঁকিপূর্ণ তা নয়। রেল লাইনের আশেপাশের এলাকাও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিবন্ধক বা পাহারাদার ছাড়া কোনো লেভেল ক্রসিং রাখার কোন অর্থ নেই। রেল লাইনের পাশে ৩ ফুট করে খুঁটির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মানুষ বাঁচানোর উন্নয়ন করতে হবে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে কৌশলী পরিকল্পনা হাতে নেয়া প্রয়োজন। নগরায়নের জন্য রেল লাইনের প্রতি কিলোমিটারের মধ্যে একটি করে লেভেল ক্রসিং তৈরি হয়ে গেছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
এই ওয়েবসাইটের লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
প্রযুক্তি সহায়তায়: রিহোস্ট বিডি