ভরা বোরো মৌসুম শেষ। তারপর চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। দেশব্যাপী অভিযান চালালেও অনেকদিন ধরেই অস্থিতিশীল চালের বাজার। সুফল পাচ্ছে না গ্রাহকরা। গরিবের মোটা চালের কেজি প্রতি দাম ৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। চিকন চালের কেজি ৬৫ থেকে ৮০ টাকা। এবার বেসরকারিভাবে আমদানির মাধ্যমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমিয়েছে সরকার। কমানো শুল্ক হারে চাল আমদানির জন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী ১৭ জুলাই পর্যন্ত খাদ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে পারবে।
এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে সচিব মো. ইসমাইল হোসেন এনডিসি ইনকিলাবকে ফোনে বলেন, চালের বাজার যে পর্যায়ে চলে গেছে সেখান থেকে আমাদের (সরকার) প্রত্যাশিত পর্যায়ে আনতে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি প্রয়োজন। সে কারণে বেসরকারিভাবে আমদানির মাধ্যমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমিয়েছে সরকার। কমানো শুল্ক হারে চাল আমদানির জন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান গুলো আগামী ১৭ জুলাই পর্যন্ত খাদ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে পারবে।
গতকাল সোমবার বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য আবেদনের আহ্বান জানিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এ পরিস্থিতিতে চাল আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করলে চালের বাজার প্রত্যাশিত অবস্থানে যাবে বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক, বিশেষজ্ঞ ও মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষকরা। করপোরেট ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা পরিকল্পিতভাবে চালের বাজার উত্তপ্ত করেছে। সেটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে করপোরেট ব্যবসায়ীরা চাল ব্যবসায় আসার পর থেকে অনেক মিল মালিক তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে আলোচনা বা নীতিমালা করার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অভিযান চালানোর মধ্যেই তাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিল ভোক্তা অধিদফতর। জেলা পর্যায়ের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, অভিযান আর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সাময়িক ফল পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদি ফল পেতে গেলে চাল আমদানির বিকল্প নেই। তাদের মতে, অনেক করপোরেট ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা প্রতিযোগিতা করে ধান কিনেছেন। তারা সাময়িক চাপে অল্প দাম কমালেও কয়েকদিন পরই আবার আগের রূপে ফিরে যাবেন। আন্তর্জাতিক বাজার ইতিবাচক আছে, কিছু আমদানির অনুমতি দিলেই চালের বাজার শান্ত হয়ে যেতে বাধ্য। দেশের মিল মালিক, করপোরেট ব্যবসায়ী, মধ্যম মানের ব্যবসায়ী এবং কৃষকদের কার কাছে কত শতাংশ ধান-চাল মজুত আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের হাতে নেই বলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা অভিযোগ তুলেছেন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, গতকাল থেকে আগামী ১৭ জুলাই পর্যন্ত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের বরাবর চাল আমদানির জন্য আবেদন করা যাবে। আবেদনকারীদের মধ্য থেকে চাল আমদানির অনুমতি দিয়ে তালিকা প্রকাশ করা হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিট (এফপিএমইউ) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর পৌনে ৪ কোটি টন চালের চাহিদা আছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ কোটি ৭৬ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে চাল উৎপাদন ও চাহিদার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। উল্লিখিত পরিসংখ্যান ধরে হিসাব করা হলেও প্রতিবছরই কিছু না কিছু চাল আমদানি হয়। এই বিষয় নিয়ে খোদ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে চালের চাহিদার তুলনায় উদ্বৃত্ত আছে। অভিযোগ উঠেছে, মিল মালিক ও করপোরেট ব্যবসায়ীরা ধান মজুত রাখার কারণে বাজারে চালের দাম বেড়ে গেছে। মূলত ধান নিয়ন্ত্রণকারী বড় বড় মিলার সিন্ডিকেটরা তাদের হাতে থাকা আগের চাল বেশি দামে বিক্রি করার জন্য এই কারসাজির আশ্রয় নিয়েছে। যে কারণে বোরোর ভরা মৌসুমে চালের দরে ঊর্ধ্বগতি। এ অবস্থায় সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী সম্প্রতি বোরো সংগ্রহের তদারকিসংক্রান্ত মাঠপর্যায়ের একাধিক বৈঠকেও প্রয়োজনে চাল আমদানি করা বিষয়টি জানিয়েছেন।
অনেকদিন ধরেই অস্থিতিশীল চালের বাজার। ভরা বোরো মৌসুমেও চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। গরিবের মোটা চালের কেজি প্রতি দাম ৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। চিকন চালের কেজি ৬৫ থেকে ৮০ টাকা। এই প্রেক্ষাপটে দাম স্থিতিশীল রাখতে শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। গত ২৩ জুন চালের আমদানি শুল্ক কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চালের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য করা হয়েছে। এর পাশাপাশি নিয়ন্ত্রকমূলক শুল্ক ২৫ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর ফলে চাল আমদানিতে মোট করভার ৬২ শতাংশ থেকে কমে ২৫ শতাংশে নামলো। নতুন শুল্ক ছাড়ের মেয়াদ আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বহাল থাকবে। এ শুল্ক ছাড়ের অনুমোদন পেতে আমদানিকারককে অবশ্যই খাদ্য মন্ত্রণালয় অনুমতি নেওয়ার শর্ত জুড়ে দিয়েছে এনবিআর। এর আগে গত দু-বছরও চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার।
ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, দেশে ধান-চালের বর্তমান মজুত পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কোনো পরিসংখ্যান জানাতে পারেননি। এটা সাধারণত খাদ্য মন্ত্রণালয় করে থাকে। আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা যেন দাম বৃদ্ধি না করে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, চালের মজুত পরিস্থিতি জানতে সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের গত ৬ জুন অধিদফতরে সভা করা হয়েছে। সেখানে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পাশাপাশি মজুত নিয়ে কারসাজি করা হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানানো হয়েছে।
রাজধানীর কৃষি মার্কেটের আশরাফ রাইস এজেন্সির কর্ণধার আশরাফ আলী বলেন, অভিযান চললেও খুচরা বাজারে চালের দামে এখনো প্রভাব পড়েনি। আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। ঢাকার বাদামতলী ও বাবুবাজার চাল আড়তদার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. নিজামউদ্দিন বলেন, বোরোর এমন সময় চালের দামের চিত্র খুবই বিস্ময়কর। এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। এমন পরিস্থিতির সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। এ অবস্থাটা সরকারকেই দেখতে হবে।