ঢাকা অফিস
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সরকারি কোম্পানিগুলো মুনাফা (প্রফিট) বোনাসের নামে গত দেড় দশকে কত টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছে, তা তদন্ত করবে অন্তর্বর্তী সরকার। যেখানে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানির জোগান নিশ্চিত করতে হিমশিম দশা, দায় পরিশোধ করতে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত, বছরে গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করা হয়, সেখানে এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা কোম্পানিগুলো কীভাবে লাভ দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে শত শত কোটি টাকা ভাগাভাগি করে নেয়Ñ উঠেছে সে প্রশ্ন। কোন আইনের বলে এমন কাণ্ড ঘটেছে, সেটা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানা গেছে। কোন কোম্পানি কত টাকা মুনাফা করেছে এবং মুনাফা বোনাস হিসেবে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কত টাকা পেয়েছেনÑ এ সংক্রান্ত তথ্য মন্ত্রণালয়ে দ্রুত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।সূত্র বলছে, রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) প্রতি বছর বিপুল অর্থ লোকসান দেখায়। এতে বছর বছর বাড়াতে হয় বিদ্যুতের দাম। ওই চাপ এসে পড়ে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে বিদ্যুৎ কিনে সেই টাকাও ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না কোম্পানিগুলো, অথচ বছর শেষে লাভ দেখিয়ে পাঁচতারকা হোটেলে সাধারণ সভা বা এজিএম করে ৫ শতাংশ মুনাফার নামে কোটি কোটি টাকা ভাগ করে নেওয়া হয়।
প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতে। অথচ পিডিবি এবং আরইবির অধীনস্থ সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদান কোম্পানিগুলো বছর শেষে লাভ দেখিয়ে বড় অংকের টাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। মুনাফা বোনাসের নামে বছরে ভাগাভাগির অর্থের পরিমাণ কম-বেশি ১০০ কোটি টাকা। সূত্র বলছে, এই টাকা পিডিবিকে ফেরত দিলে সরকারের ভর্তুকির চাপ কমত।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৬ বছরে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটি লোকসান দেখিয়েছে ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ সময় পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে লোকসান কমানোর চেষ্টা করেছে সরকার। ভর্তুকি দিয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। এরপরও এই সময় সাধারণ গ্রাহকের বিদ্যুতের দাম বেড়েছে প্রায় ১৮৮ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান হয়েছে ১১ হাজার
৬৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে সরকারি পাঁচটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি নিট মুনাফা করেছে ১ হাজার ৫১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর ৫ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুনাফা বোনাস হিসেবে দাঁড়ায় ৭৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। যে কোম্পানি যত বেশি লাভ করে, সেই কোম্পানির কর্মীরা যে অনুযায়ী মুনাফা বোনাস পান।
সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীনস্থ লাভে থাকা কোম্পানিগুলো হলোÑ আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি (এপিএসসিএল), ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি (ইজিসিবি), নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (নওপাজেকো), রুরাল পাওয়ার কোম্পানি (আরপিসিএল) এবং বি-আর পাওয়ার জেন (বিআরপিএল)। এর আগের তিন অর্থবছরও এই কোম্পানিগুলো লাভে ছিল।
পরের অর্থবছরগুলোয় মুনাফা বোনাসের নামে কম-বেশি ১০০ কোটি টাকা ভাগাভাগি হয়েছে এসব কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। লাভের অনুপাতে বছরে ৩ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত এই বোনাস পেয়েছেন তারা।
লাভ দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মুনাফা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়ার নজির জ্বালানি খাতের সরকারি কোম্পানিতেও আছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৮ লাখ টাকা করে মুনাফা বোনাস দিয়েছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড।
মুনাফা বোনাস পাওয়া কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের দাবি, শ্রমিক আইন অনুযায়ী কোম্পানির বাৎসরিক মুনাফার ৫ শতাংশ বোনাস তারা পেয়ে থাকেন। তবে ক্রমাগত লোকসানে থাকা বিদ্যুৎ খাতের জন্য এই আইন কতটা প্রযোজ্য, তা নিয়ে আলোচনা আছে।
এদিকে মুনাফা বোনাস ভাগাভাগির বিষয়ে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতের পরামর্শক সংস্থা পাওয়ার সেলের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতের কোম্পানিগুলোতে বোর্ড চেয়ারম্যান থাকেন খোদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিবরা। সবগুলো বোর্ডে মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব থেকে যুগ্ম সচিব সবাই বোর্ড সদস্য থাকেন। ফলে কোম্পানির গাড়ি ব্যবহার থেকে শুরু করে বোর্ড মিটিংয়ের সম্মানি, মুনাফা বোনাসের নামে অর্থ ভাগাভাগির মতো নানা কাণ্ড ঘটান বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কোম্পানির কাজ কোন ঠিকাদার পাবে, আর কে পাবে না- তাও নিয়ন্ত্রণ করতেন বোর্ড সদস্য ও চেয়ারম্যান-এমডিরা।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, কোম্পানিগুলোর বেশিভাগেরই স্বতন্ত্র পে-স্কেল বা আলাদা বেতন কাঠামো রয়েছে। সরকারে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থেকে কোম্পানিগুলোর কর্মীরা বেশি বেতন পান। আবার মুনাফা বোনাস ভাগাভাগি করে অর্থ লুট করা হয়েছে রাষ্ট্রের। এগুলো সংস্কার করা জরুরি।
পিডিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, আইনটা মূলত হয়েছিল গার্মেন্টস শ্রমিক, বেসরকারি শিল্প ও কলকারখানা শ্রমিকদের জন্য। সরকারি অন্যান্য চাকরির তুলনায় রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রায় আড়াই গুণ বেশি বেতন-ভাতা পান উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, মুনাফা বোনাসের এই আইন সরকারি বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয়।
সুত্র: আমাদের সময়