দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পানি কিছুটা কমলেও বাড়ছে মধ্যাঞ্চলের পানি। পদ্মার উজানে ভারতের গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেওয়ায় দেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত রয়েছে। এতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলছে। দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট। কোন কোন এলাকায় ত্রাণের কোন দেখা নেই। ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে মানুষ। বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে দেখা দিচ্ছে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানান রোগ। চিৎসারও কোন সুব্যবস্থা নেই। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই হচ্ছে না মানুষের। সব মিলিয়ে বন্যার্তরা দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব মতে বন্যায় ইতোমধ্যে ৪২ জন মারা গেছে। এদের মধ্যে সিলেট বিভাগে ২১ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে বেসরকারি হিসাব মতে বন্যায় মৃতের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। গবাদি পশু কি পরিমাণ মারা গেছে তার সঠিক হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। যে সব গবাদি পশু এখনো বেঁচে আছে তাদের খাদ্য সঙ্কটও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম থেকে শফিউল আলম জানান, উজানে উত্তর-পূর্ব ভারতে অতিবৃষ্টিতে ঢল-বন্যার পানি আসা অব্যাহত রয়েছে। ভারত নিজেদের বন্যামুক্ত রাখতে পদ্মা নদীর উজানে গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তার উজানে গজলডোবা বাঁধসহ সব নদ-নদীর উৎসে বাঁধ-ব্যারাজ খুলে পানি ছেড়ে দিয়েছে। ফলে দেশের প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে বন্যা পরিস্থিতির কোথাও অবনতি ঘটছে। কোথাও অপরিবর্তিত রয়েছে। আবার নতুন করে বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে কোন কোন এলাকা। বৃহত্তর সিলেট, নেত্রকোণাসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। ফারাক্কার পানিতে অন্যতম প্রধান অববাহিকা পদ্মায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত এ মুহূর্তে লাখ লাখ মানুষ বন্যায় পানিবন্দী। অনেকেই নদীভাঙনে দিশেহারা। বসতঘর, রাস্তাঘাট, স্কুল-মাদরাসা, হাট-বাজার বিলীন হয়ে যাচ্ছে উত্তাল নদীগর্ভে। সর্বস্ব হারিয়ে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ছে।
গতকাল বিকেল পর্যন্ত পদ্মা, যমুনা-ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, সুরমা, কুশিয়ারা, তিতাসসহ ১২টি নদ-নদী ২২টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়। বর্তমানে বন্যা ও নদীভাঙন কবলিত জেলাগুলো হচ্ছেÑ সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
গতকাল বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নদ-নদীর পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে বলা হয়, ব্রহ্মপুত্র নদের পানির সমতল অপরিবর্তিত রয়েছে। অন্যদিকে যমুনা ও পদ্মা নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুশিয়ারা ও তিতাস ব্যতীত অন্যান্য প্রধান নদ-নদীর পানির সমতল হ্রাস পাচ্ছে।
গতকাল পাউবোর ১০৯টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৬১টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৪৭টিতে হ্রাস পায়। একটি স্থানে পানির সমতল অপরিবর্তিত থাকে। এরমধ্যে গতকাল বিকেল পর্যন্ত ১২টি নদ-নদীর ২২টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গতকাল বিকেল পর্যন্ত বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীসমূহ হচ্ছেÑ পদ্মা একটি পয়েন্টে (সুরেশ^র), ব্রহ্মপুত্র নদ তিনটি পয়েন্টে, যমুনা ৫টি পয়েন্টে, ধরলা ও ঘাগট একটিতে, আত্রাই নদী একটিতে, সুরমা তিনটি পয়েন্টে, কুশিয়ারা দু’টিতে, পুরাতন সুরমা, বাউলাই, সোমেশ্বরী ও তিতাস প্রতিটি একটি করে পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আরো বিভিন্ন স্থানে নদ-নদী বিপদসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় দেশের অনেক জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি ধরণের বৃষ্টিপাত হয়েছে। কোথাও কোথাও ভারী বর্ষণ হয়। এ সময়ে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে মাদারীপুরে ৯৬ মিলিমিটার। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল সৈয়দপুরে ৩৪.৫ এবং সর্বনিম্ন সীতাকুণ্ডে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩২.৪ এবং সর্বনিম্ন ২৭ ডিগ্রি সে.। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে ছিটেফোঁটা বৃষ্টিপাত হয়।
আবহাওয়া বিভাগ জানায়, বর্ষারোহী মৌসুমী বায়ুর একটি অক্ষ বা বলয় ভারতের বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর মোটামুাটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানা গেছে, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়ার সাথে প্রবল বিজলী চমকানোসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেই সাথে রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে। এরপরের ৫ দিনে আবহাওয়ার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।
সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গত মঙ্গলবার সারাদিন সিলেটের আকাশ অনেকটা পরিষ্কার থাকলেও গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে। জেলার কয়েকটি উপজেলার বিস্তৃর্ণ অঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। কুশিয়ারা ও সারি নদীর দুটি পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার নিচে থাকলেও অন্যান্য নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে, ত্রাণ নিয়ে বন্যার্তদের মাঝে হাজির হচ্ছেন অনেকেই। এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন সংগঠন। পাউবো’র তথ্য মতে, সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওই পয়েন্টে পানি ১৩ দশমিক ৭৬ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছিল। গতকাল সকাল ৯টায় ওই পয়েন্টে পানি ১৩ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছে। নদীর সিলেট পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে ছিল ১১ দশমিক ১৬ সেন্টিমিটার। গতকাল সকাল ৯টার সেখানে পানি ছিল ১১ দশমিক ১১ সেন্টিমিটার। সিলেট সিটি করপোরেশন জানায়, নগরীতে ৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে প্রায় ৭ হাজার বন্যাকবলিত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। সিলেট সিটি করপোরেশনের পানি সরবরাহ করার পাম্পগুলো বন্যার পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় পানি সরবরাহ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে পানি সরবরাহের ভ্রাম্যমাণ ট্যাংকের মাধ্যমে নগরীর বাসিন্দাদের সরবরাহ করা হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি। সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান ইনকিলাবকে জানান, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ পাওয়া চাল বিতরণ করা হচ্ছে ।
সুনামগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, জেলার সুরমা নদীর পানি বেড়ে বন্যা প্লাবিত হয়ে বাড়িঘর পানির নিচে। তাই বানভাসি মানুষেরা আশ্রয় কেন্দ্রে জায়গা না পেয়ে এখন নৌকার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানেই খাবার সংকটে অনাহারে অর্ধাহারে তাদের কাটছে দিন-রাত। সকল টিউবওয়েল পানির নিচে থাকায় বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়ে গেছে। পয়নিস্কাশনের ব্যবস্থাও নাই। অপরদিকে যতদিন যাচ্ছে, আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে দেখা দিচ্ছে রোগ বালাই। দুর্যোগে ত্রাণ সহয়তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আর দুর্ভোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। দুর্গম হাওড় পাড়ে কোথাও এক হাত জায়গা নেই দাঁড়ানোর। বাড়িঘর, হাট-বাজার,পাশের স্কুল, মসজিদ, মাদরাসও পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া কোনো উপায় না পেয়ে নৌকা, লঞ্চ, বিদ্যালয়ের ছাদে আশ্রয় নিয়েছেন মানুষ ও গরু-ছাগল। মানুষের খাবারের পাশাপাশি গো-খাদ্যেরও চরম অভাব দেখা দিয়েছে। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে কবরস্থানে জায়গাতে পানি উঠায় লাশ নিয়েও বিপাকে পড়েছে নিহতের স্বজনরা। সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর গ্রামে ঘটনাটি ঘটে। গতকাল বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের একটি অভিযাত্রী দল ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারেন, গত শুক্রবার দুইজন বৃদ্ধ পুরুষ স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হয়। বন্যার কারণে গ্রামের পঞ্চায়েতী কবরস্থানসহ আশপাশের সব জায়গায় পানিতে ভরে যায়। কোথাও লাশ দাফনের সুযোগ না পেয়ে গতকাল সকালে কাঠের কফিন তৈরী করে মাটির উপরেই একজনকে দাফন করা হয় এবং অপর জনের লাশ কাঠের কফিনে করে বাশঁ দিয়ে মাটির উপরে আটকে রাখা হয়।
মৌলভীবাজার জেলা সংবাদদাতা জানান, জেলার সদর উপজেলার শেরপুরে খাদ্য গুদামে পানি প্রবেশ করায় টিসিবির মজুত রাখা ডাল, চিনি ও তেল অন্যত্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জ্যোতি বিকাশ ত্রিপুরা জানান, শেরপুরে দুটি খাদ্য গুদাম টিসিবি ব্যবহার করছে। এবিষয়ে টিসিবির আঞ্চলিক কর্মকর্তা মো. ইসমাইল মজুমদারের সাথে মুঠোফোনে জানান, গুদামে ৫৬৬ টন ডাল, ৩২০ টন চিনি ও ৬৫ হাজার লিটার তেল মজুত ছিল। গুদাম থেকে এসব পণ্য কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। পানিতে ডাল ও চিনির বেশি ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার হামরকোনা এলাকায় কুশিয়ারা নদীর বাঁধ উপচে বন্যার পানি এখনও প্রবেশ করে নতুন নতুন এলাকা এখনো প্লাবিত হচ্ছে। কুশিয়ারা, ফানাই, কন্টিনালা ও জুড়ী নদী দিয়ে আসা পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যা কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা ও রাজনগর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বন্যায় জেলায় ৪২টি ইউনিয়নের ৫ শ গ্রামের ৩ লাখ মানুষ পানিবন্ধি অবস্থায় আছে। জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান ইনকিলাবকে জানান, ইতিমধ্যে বন্যা কবলিত এলাকায় ১০১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে ২৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যার্তদের জন্য ২০ লাখ বরাদ্দকৃত টাকা বিতরণের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। এদিকে কুলাউড়ার উপজেলার বরমচাল ও ছকাপন রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তীস্থানে রেল সড়কে বন্যার পানি উঠেছে। যে কোন সময় সারাদেশের সাথে সিলেট অঞ্চলের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে।
ফেনী জেলা সংবাদদাতা জানান, জেলার ফুলগাজীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বেরিয়ে আসছে বন্যা পরবর্তী ক্ষতচিহ্ন। গত সোমবার সকালে ফুলগাজী-পরশুরাম উপজেলায় মহুরী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪টি স্থানে ভেঙ্গে ১৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। লোকালয়ে পানি ডুকে পড়ায় মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসলী জমিতে আবাদকৃত সবজি,বীজতলা ও মৎস্য ঘের পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ওইদিন পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় অবস্থিত মুহুরী রেগুলেটরের সব গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। গত তিনদিনে বন্যার পানি নামতে শুরু করায় ইতোমধ্যেই ক্ষয়-ক্ষতি দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে বাঁধ ভাঙ্গা এলাকায় রাস্তার উপর দিয়ে পানি বয়ে যাওয়ায় কিছু কিছু রাস্তা প্রায় বিলিন হয়ে পড়েছে। এছাড়াও উপজেলায় অন্তত ২৪৭টি পুকুরে পানি ঢুকে ৮০ লাখ টাকার মাছ ভেসে ভেসে গেছে। ফুলগাজী উপজেলা প্রকৌশলী সৈয়দ আসিফ মুহাম্মদ জানান, বন্যার পানি এখনো পুরোপুরি নেমে যায়নি। বেশ কয়েকটি রাস্তার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। কয়েকটি রাস্তার ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। শিঘ্রই এসব সড়কের তালিকা প্রস্তুুত করে দ্রুত সংস্কারের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সিরাজগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে জেলার অভ্যন্তরীণ নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি বাড়ছে। ফলে জেলার নিম্নাঞ্চলের প্রায় শতাধিক গ্রাম বন্যা কবলিত হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, ইতোমধ্যে জেলার ৬০৯২ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে । জানা যায়, জেলার সিরাজগঞ্জ সদর, কাজীপুর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের প্রায় ২০ ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাটবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বন্যাকবলিতরা। জেলার পাউবো জানায়, যমুনা নদীর পানি বাড়ায় জেলার করতোয়া, ইছামতি, ফুলঝোড়, বড়াল, হুড়াসগড় ও চলনবিলের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় একদিকে যেমন জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে অন্যদিকে এসব এলাকার জমির ফসল প্লাবিত হচ্ছে। এই ফসলের বেশিরভাগ অংশই নষ্ট হওয়ার পথে।
কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদতা জানান, জেলার বন্যা যত স্থায়ী হচ্ছে ততই দুর্ভোগ বাড়ছে বানভাসীদের মধ্যে। বেশিরভাগ পরিবার বাড়ীর ভিতর চৌকি উঁচু করে কষ্ট করেই সেখানে অবস্থান করছে। কেউ কেউ নৌকায় গবাদিপশু নিয়ে দিনরাত পার করছে, কখন পানি নেমে যাবে। এই পরিস্থিতিতে বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনো খাবার ও ল্যাট্রিন সংকটে ভুগছেন তারা। সমস্যায় পরেছেন গবাদিপশুর খাবার নিয়ে। চারণভূমিসহ মাঠঘাট তলিয়ে যাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পার্বতীপুর গ্রামের আবুল হোসেন জানান, ‘নিজেরা না হয় কোন রকমে চলবের নাগছি ্িকন্তু গরু-ছাগল নিয়া খুব বিপদে আছি। খড়ের গাদা পানিতে ভিজি গেইছে। এখন কি দেই আর কি খাওয়াই। খুব দুশ্চিন্তায় আছি’। জেলা ত্রাণ ও পূনর্বাসন অফিসের তথ্য মতে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৪১ হাজার ৬১২জন মানুষ পানিবন্দী হয়েছে। নাগেশ^রী উপজেলায় ৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৬০জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। বন্যায় ৩২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানি থাকায় পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। বানভাসী মানুষের কথা চিন্তা করে ৩৬১টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এদিকে সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অনেক পানিবন্দী এলাকায় সরকারি বা বেসরকারীভাবে কেউ খোঁজ নিতেও আসেনি বলে বানভাসীরা অভিযোগ তুলেছে। জেলার পাউবো’ প্রকৌশলী আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন ইনকিলাবকে জানান, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপৎসীমার ওপর কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। বন্যার পানি ধীর গতিতে কমতে শুরু করেছে বলে জানান তিনি। গতকাল ব্রহ্মপুত্রর পানি চিলমারী পয়েন্টে ৫৩ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়ায় ১৯ সেন্টিমিটার এবং ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে ৪১ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
টাঙ্গাইল জেলা সংবাদদাতা জানান, জেলার বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ইতিমধ্যে জেলার এক লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সড়ক ভেঙে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এছাড়াও বন্যাকবলিত এলাকায় ৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি উঠায় পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। গবাদিপশু নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে বানভাসি মানুষ।
চিলমারী (কুড়িগ্রাম) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি গতকাল বিপৎসীমার ৫১ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬ টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৫৭ সেন্টিমিটার ওপরে ছিলো। এর ফলে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। জেলার সব কয়েকটি নদ-নদীর পানি কিছুটা কমেছে। আগামী ২৪ ঘন্টায় পানি আরও কমতে পারে বলে জানিয়েছেন জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড। এদিকে বন্যা পানি কমতে শুরু করলেও পানিবন্দিদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। এখন পর্যন্ত চিলমারী উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছে। চরাঞ্চলের সবাই এখন আশ্রয়নকেন্দ্রের বাসিন্দা। এদিকে জোড়গাছ থেকে কাঁচকোল ফকিরের হাট পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ রক্ষা বাঁেধ আশ্রয় নিয়েছেন অনেকেই। বন্যা কবলিতার জানান, খাদ্য ও প্রয়োজনীয় ওষুধসহ গবাদিপশুর গো-খাদ্যের চরম সংকটে রয়েছেন । উপজেলা নিবার্হী অফিসার মো. মাহবুবুর রহমান জানান, পযার্প্ত পরিমাণ খাবার মজুদ রয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছি।
সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) উপজেলা সংবাদদাতা, সুন্দরগঞ্জে বন্যায় ৪ হাজার পরিবার পানিবন্দি । বন্যার পানি পানি উঠায় ২৭ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যায় এপর্যন্ত ৪ হাজার পরিবারের প্রায় ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঘর থেকে বের হতে না পেরে বানভাসিদের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। কৃষকরা উচু এলাকায় গৃহ পালিত পশু-পাখি স্থানান্তর করে সেখানেই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। বেশি দুর্দশায় পড়েছেন চরাঞ্চলের বানভাসিরা। সরেজমিনে দেখা গেছে, জরুরী প্রয়োজনে নৌকা বা কলা গাছের ভেলায় চড়ে বন্যা কবলিত লোকজন যাতায়াত করছেন। পানিবন্দী থাকার কারণে বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওয়ালিফ মন্ডল জানান, এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৫৫০ পরিবারের প্রায় ১১ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। পানিবন্দি ইউনিয়নগুলো হচ্ছে উপজেলার তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, শ্রীপুর, চন্ডিপুর ও কাপাসিয়া।
বালাগঞ্জ (সিলেট) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ওসমানীনগরে বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়ে অবস্থা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুঁটছেন। এদিকে আশ্রকেন্দ্রগুলোতে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। মানবেতর জীবন যাপন করছেন বানভাসী মানুষ। গতকারও পানি প্রায় ১ ফুট বেড়েছে। শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। এদিকে সংকটময় সময়ে এক শ্রেণি অসাধু ব্যবসায়িরা নিত্যপন্য জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি করে দিয়েছে। ফলে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওসমানীনগর উপজেলা সুত্রে জানা যায়, ওসমানীনগরের ৮টি ইউনিয়নের মানুষের জন্য ৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে আশ্রয় নিয়েছেন ১ হাজার ১৭০টি পরিবার। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিটি আশ্রকেন্দ্রের চারিদিকে কোমর পানি। গবাদি পশুর সাথে আশ্রিত মানুষ বসবাস করছেন। সরকারি কোন ত্রাণ না পওয়ায় তারা অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।