আধুনিকতার নামে কয়েক তরুণীর পোশাক পরিধানে ‘মাই বডি মাই চয়েস’ কর্মসূচির প্রতিবাদে ‘ছোট পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী নয়, পণ্য বানায়’ শীর্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল শিক্ষার্থী ব্যানার প্লাকার্ড নিয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। এ সময় তারা ‘ছোট পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী বানায় না, পণ্য বানায়’, ‘পোশাকের স্বাধীনতার নামে পাবলিক নুইসেন্স বন্ধ হোক’ প্রভৃতি লেখা সম্বলিত বিভিন্ন প্লাকার্ড প্রদর্শন করে। তাদের ভাষ্য-পাবলিক নুইসেন্স এক ধরনের ক্রাইম। প্রাইভেট প্লেস আর পাবলিক প্লেসের ড্রেস কখনো এক না। অনেকে পোশাকের স্বাধীনতার নামে পশ্চিমা অপসংস্কৃতি আমদানি করে পাবলিক প্লেসে মানুষকে কষ্ট দেয়, এটা অবশ্যই অন্যায়। সে তার বাড়িতে সেই স্বাধীনতা পালন করুক, পাবলিক প্লেসে সবার মূল্যবোধ মেনেই তাকে চলতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীদের ‘মানববন্ধন কর্মসূচি এবং বক্তব্য’ পথচারীদের আকৃষ্ট করেছে। যারা ওই পথে চলাচল করেছেন তাদের সবাই ক্ষণিকের জন্য হলেও দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের বক্তব্য শোনেন। এই হলো ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চার রুচিবোধ। মনিষীরা বলে থাকেন, পোশাক মানুষের শিক্ষা, রুচিবোধ, সংস্কৃতি, পারিবারিক আভিজাত্য, মূল্যবোধের পরিচয় ফুটিয়ে তোলে। পশ্চিমাদের সংস্কৃতি, সামজিক মূল্যবোধ ও পোশাক পরিচ্ছেদ আর এশিয়ার সংস্কৃতি, সামজিক মূল্যবোধ ও পোশাক পরিচ্ছেদ এক নয়। কিন্তু দেশের এক শ্রেণীর তথাকথিত সংস্কৃতিসেবী ও উচ্চ শিক্ষিত মানুষ আধুনিকতার নামে পশ্চিমা সংস্কৃতি চর্চায় ব্রতী হয়ে দেশে কৃষ্টি কালচার, সভ্যতা-ভব্যতা বিনষ্টের চেষ্টা করছে। তারা অল্প বয়সী মেয়েদের দেশি ও পাশ্চাত্যের সমন্বয়ে আটোসাটো এক বিচিত্র পোশাক পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। ফ্যাশনেবল পিঠখোলা বা শরীরের কিছু অংশ প্রদর্শন করা পোশাককে আধুনিকতা মনে করেন।
এর আগে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী গত ১৮ মে নরসিংদী রেলস্টেশনে আটোসাটো পোশাক পড়ায় মারধরের শিকার হন। তার সঙ্গে থাকা দুই বন্ধুও মারধরের শিকার হন। ওই মারধোর ও গালিগালাজ করে পুরো দৃশ্যের একটি ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করা হয়। এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনা-বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এরপর নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির পক্ষ থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ভৈরব রেলওয়ে থানায় মামলা করা হয়। এ নিয়ে প্রতিবাদকারী মার্জিয়া আক্তার ওরফে শিলাকে গ্রেফতার করা হয়। এনিয়ে বিতর্কের মধ্যেই গ্রফতারকৃত আসামীর জামিন ইস্যুতে ১৬ আগষ্ট হাইকোটে উঠে। নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাকের জন্য তরুণীকে হেনস্তার প্রসঙ্গ নিয়ে হাইকোর্ট প্রশ্ন রেখেছেন, সভ্য দেশে এমন পোশাক পরে রেলস্টেশনে যাওয়া যায় কি না। আদালত বলেছেন, ‘(ওই তরুণী) প্ল্যাটফর্মে আপত্তিকর অবস্থায় ছিল, সিডিতে দেখা যায়। এটি আপনার অধিকার? পোশাকের অধিকার?’ বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হয়। শুনানি নিয়ে আদালত মার্জিয়া আক্তার ওরফে শিলাকে ৬ মাসের অন্তবর্তীকালীন জামিন দিয়েছেন। শুনানির একপর্যায়ে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সৈয়দা জাহিদা সুলতানা বলেন, ‘কী পোশাক পরবে, সে বিষয়ে ব্যক্তির অধিকার আছে’। তখন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করার অধিকার আছে কি না? পোশাক সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না? যে সমাজে যাবেন, সে সমাজের আর্থসামাজিক অবস্থাও একটি বিষয়। ঢাকায় এক ধরনের, গ্রামে অন্য ধরনের।’
আদালতের এমন সুচিন্তিত বক্তব্যের প্রতিবাদে ২২ আগষ্ট আদালত প্রাঙ্গণে ১৪ জন তরুণী বিক্ষোভ করেন। তথাকথিত আধুনিক এবং আটোসাটো পোশাক পড়তে অভ্যস্ত ওই তরুণীরা তাঁদের হাতে মুখে নানান সেøাগান দেন। তারা ‘মাই বডি মাই চয়েস’,‘অশ্লীল নজর অসভ্যতা’,‘নজর সামলে রাখুন’ সেøাগানের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেন। দাবি করা হয় ওই কর্মসূচিতে অংশ নেন শিল্পী থেকে নাট্যকর্মী, গবেষক, শিক্ষক, ইত্যাদি পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকা মহিলারা। তাঁদের সবার একটাই মত ছিল সরকার বা আদালত কেউই কখনও ঠিক করে দিতে পারেন না যে মহিলারা কী পরবেন আর কী নয়। তাঁদের জীবন যখন, তাঁদের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে নিজের পছন্দ মতো পোশাক পরার। আদালত প্রাঙ্গণে আটোসাটো পোশাকের পক্ষ্যে অবস্থান নেয়া তরুণীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেয়েদের মাথায় হিজাব বা ওড়না পরার বিপক্ষ্যে। তাদের বক্তব্য মেয়েরা আধুনিক হতে প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি পরা শুরু করেছে। তার বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মে কিছু ব্যাক্তি বিরোধিতা করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই বিক্ষোভ? যে তরুণীরা ‘মাই বডি মাই চয়েস’ শ্লোগান দেন তারা কারা? তাদের পরিচয় কি?
অপ্রিয় হলেও সত্য এক সময় মানুষ পশুর চামড়া, গাছের ছাল ও গাছের পাতা পরিধান করতেন। তখন ছিল আদিম যুগ। এখচ চলছে আধুনিক যুগ। আদিম আর আধুনিকতার মধ্যে বিস্তর ফারাক। ওই (আদিম) যুগে পোশাক ছিলো না বলে নারী-পুরুষ গাছের ছাল-বাকল দিয়ে লজ্জাস্থান ঢাকতেন। যদিও বাকি শরীর থাকতো নগ্ন। আর এখন আধুনিক হওয়ার পর আধুনিকতার নামে কিছু মানুষ ধীরে ধীরে আদিমযুগেই চলে যাচ্ছেন। এ যুগে হাজার রকম পোশাকের ভারে ভারাক্রান্ত মানুষ। একেকজনের সংগ্রহে রয়েছে কত বিচিত্র যে পোশাক তার ইয়ত্তা নেই। অথচ এখন ‘মাই বডি মাই চয়েস’ শ্লোগানের মাধ্যমে আধুনিক যুগের কিছু নারী-তরুণী সেই আদিম স্টাইলেই কোনোরকমে লজ্জাস্থান ঢেকে ঢুকে শরীরের সব অংশ বের করে রাখার পোশাক পড়ছে। তাহলে পোশাক উন্নত হওয়া বা পোশাকে বৈচিত্র আসায় কী লাভ হলো? আধুনিকতার নামে আদিম যুগের অর্ধনগ্ন পোশাক পড়ে শরীর প্রদর্শনের মধ্যে পোশাক থাকা আর না থাকার নামান্তর নয় কি?
ইউরোপ, আমেরিকার দিকে তাকালে কি দেখা যায়? সেখানেও নারীদের মধ্যে পারিবারিক কিংবা ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে হোক হোক, বিভিন্ন ডিজাইনের হিজাব/বোরখা পরার প্রবণতা বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া তরুণীরা হিজাব, বোরকা পড়তে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সে চিত্রই দেখা যায়।
গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, গত ১৬ আগস্ট একটি মামলার পর্যবেক্ষণে উচ্চ আদালত পোশাকের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘সভ্য দেশে এমন পোশাক (আটোসাটো) পরে রেলস্টেশনে যাওয়া যায় কি না? কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করার অধিকার আছে। পোশাক সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না? যে সমাজে যাবেন, সে সমাজের আর্থসামাজিক অবস্থাও একটি বিষয়। মানববন্ধনে অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মুহিউদ্দিন রাহাত বলেন, বাক স্বাধীনতার অর্থ যেমন অন্যকে গালি দেয়া নয়, ঠিক তেমনি ‘পোশাকের স্বাধীনতার’ অর্থ অন্যকে বিরক্ত করা নয়। পোশাকের স্বাধীনতার নামে এমন পোশাক পরা কখনই ঠিক না, যা পাবলিক নুইসেন্স বা গণ উৎপাত বা বিরক্তি তৈরি করে।
মানববন্ধনে অংশ নেওয়াদের একজন দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী রেহানা রাহী। তিনি বলেন, সংস্কৃতি অবশ্যই পরিবর্তনশীল। কিন্তু আমরা যে সংস্কৃতি গ্রহণ করবো, সেটা অবশ্যই আমাদের দেশীয় মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। আজকাল পোশাকের স্বাধীনতার নামে যে পশ্চিমা অপসংস্কৃতি আমদানি করা হচ্ছে, তা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে। এটা এক ধরনের কালচারাল টেরোরিজম।
এসময় শিক্ষার্থীরা পোশাকের নামে ‘পশ্চিমা অপসংস্কৃতি’ আমদানিকারকদের আইনের আওতায় এনে বিচার দাবি করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রত্যেক তরুণীর সাজপোশাকে স্বাধীনতা থাকা উচিত। স্থান-কাল-সময় বুঝে পোশাক পরই পোশাকের স্বাধীনতা। পোশাকের মধ্য দিয়ে একজন নারীর রুচিশীলতা, ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। সাজপোশাকের মধ্য দিয়ে নগ্নতা বা উগ্রতা ফুটে তোলা আধুনিকতা নয়। ভারতের একটি প্রবাদ চালু রয়েছে ‘আপকা রুচি খানা/ পর রুচি পরনা’ (নিজের রুচি বা পছন্দমাফিক খাবার খাও, পরের রুচি বা পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে পোশাক পরো)। ওটা বিধর্মীদের ক্ষেত্রে হলেও হতে পারে। কিন্তু মুসলমান তথা বাংলাদেশের সমাজের জন্য নয়। আটোসাটো, অর্ধলগ্ন শরীরের তথাকাথিত অধুনিক পোশাক নয়; বরং শালীন পোশাক স্মার্টলি ক্যারি করলেও তরুণী ও নারীদের সুন্দর দেখায়। আধুনিক হবার নামে ছেলেদের মতো প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি পরলে তরুণীদের আধুনিকতার প্রকাশ ঘটে না। প্রশ্ন হচ্ছে দেশের ছেলেরা শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি পরে এগিয়ে যাচ্ছে; আর মেয়েরা শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ পরে কি পিছিয়ে পড়েছে?
আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘(হে নারী জাতি, তোমরা সব গৃহে অবস্থান করো এবং প্রাক ইসলামি (জাহেলিয়াতী) যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে রেড়িওনা’ (সুরা আল আজহার, আয়াত-৩৩)।