1. rashidarita21@gmail.com : bastobchitro :
পাসপোর্টের জন্য প্রবাসীদের কান্না | Bastob Chitro24
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৪ পূর্বাহ্ন

পাসপোর্টের জন্য প্রবাসীদের কান্না

ঢাকা অফিস
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট, ২০২২

ইতালিতে দূতাবাস ঘেরাও, ফ্রান্স-গ্রিসে কর্মসূচি

নানা জটিলতায় পাসপোর্ট অধিদপ্তরে আটকে আছে হাজারও প্রবাসীর আবেদন। কেউ নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেছেন। কেউ সংশোধন চেয়েছেন। বৈধ কিংবা অবৈধ উপায়ে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছিলেন তারা। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পর ওইসব দেশে বৈধভাবে অবস্থানের সুযোগ পেলেও পাসপোর্ট না থাকায় দেশে আসতে পারছেন না এই প্রবাসীরা। জটিলতা নিরসনের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগও নেই। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে মৃত্যুর হাতছানি উপেক্ষা করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তারা পাড়ি জমিয়েছেন। ওইসব দেশে তারা বৈধভাবে বসবাসের সুযোগ পেলেও বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিতে পারছেন না। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ রকম ১০/১২ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন পাসপোর্ট জটিলতায়। পাসপোর্ট না পেয়ে চরম দুর্ভোগ এবং হতাশায় নিমজ্জিত রেমিট্যান্স যোদ্ধারা।

দেশে অনেকের পরিবার ঋণগ্রস্ত। অনেকের বাবা-মা গুরুতর অসুস্থ। কারো কারো মা-বাবার মৃত্যু ঘটেছে দেখারও সুযোগ পায়নি। পাসপোর্ট না থাকায় বৈধ পথে তারা রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন না। অনেকে কাজ-কর্ম হারিয়ে দিনে দিনে বেকার হয়ে পড়ছেন। এর প্রভাব পড়ছে দেশে থাকা পরিবারের ওপর। অভাবের কারণে অনেকের ছেলেমেয়ে ও ছোট ভাইবোনের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল দুপুরে পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরে গিয়ে দেখা যায়, প্রবাসীর স্বজনরা পাসপোর্ট অফিসে এসে ভিড় করছেন। অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

ইতালি প্রবাসী সাইফুদ্দিনের বড় ভাই সোহেল জানান, তার ভাই ২ বছর হলো লিবিয়া থেকে ইতালিতে গেছেন। এতে তিনি পথে তার পাসপোর্টটি হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি আরও জানান, ওই দেশে তিনি রাজনৈতিকভাবে আশ্রয় পেয়েছেন। এখন তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট দরকার। কিন্তু, এখন পর্যন্ত তিনি পাসপোর্টটি পাননি। শুধু অফিসের লোকজন বলছেন যে, তার পুরনো পাসপোর্টটি জমা দিতে হবে। বার বার বলার পরও তারা বিশ্বাস করছেন না যে তার পাসপোর্ট নেই। এতে তার ভাই ভোগান্তির মধ্যে আছেন। শরীফ নামে আরেকজন প্রবাসীর ভাই জানান, তার ছোট ভাই থাকেন গ্রিসে। স্টুডেন্ট ভিসায় গেছেন সেই দেশে। তার পাসপোর্টটি হারিয়ে যাওয়ায় পড়াশুনায় অসুবিধা হচ্ছে। বার বার আবেদন করার পরও তিনি সাড়া পাচ্ছেন না। মাদারীপুর থেকে ঢাকার আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অধিদপ্তরে খোঁজ নিতে আসা নজরুল ইসলাম জানান, ৭/৮ বছর আগে তার ছেলে ইরাকে যায় শ্রমিক হিসেবে। এরপর সেখান থেকে অবৈধ পথে ফ্রান্সে পাড়ি জমায়। এই যাত্রায় সে তার এমআরপি পাসপোর্টটি ফেলে দেয়। ফ্রান্সে বৈধতা পাওয়ার পর সে পুনরায় প্যারিস দূতাবাসে এমআরপি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে। পুলিশ ভেরিফিকেশনও হয় তার। কিন্তু পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে বলা হচ্ছে, ভেরিফিকেশন রিপোর্ট আসেনি। তাদের সার্ভারে পুলিশ ভেরিফিকেশন পেন্ডিং দেখাচ্ছে। অথচ আবেদনকারী হিসেবে আবেদনের অবস্থা সার্ভারে যাচাই করতে গেলে সেখানে লেখা দেখাচ্ছে, পুলিশ ভেরিফিকেশন অ্যাপ্রুভড। নজরুল ইসলাম বলেন, সংশ্লিষ্ট অফিসারকে অনুরোধ করেছেন।

কিন্তু তারা পুরনো এমআরপি ছাড়া কোনোভাবেই নতুন পাসপোর্ট দিবে না। ফলে তার ছেলে দেশে আসতে পারছে না। ছেলেকে একনজর দেখার জন্য দিনের পর দিন ধরনা দিচ্ছেন পাসপোর্ট অধিদপ্তরে। একই রকম ভোগান্তির শিকার হয়েছে প্যারিস দূতাবাসে পাসপোর্টের আবেদন করা মিজানুর রহমান। তিনি হাতে লেখা পাসপোর্ট নিয়ে ২০১২ সালে অবৈধভাবে ওমান থেকে ফ্রান্সে যান। এরপর ফ্রান্সে বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি পান তিনি। এই হাতে লেখা পাসপোর্ট তিনি দেশে ফেরত পাঠান। এরমধ্যে দেশে আসার প্রয়োজন বোধ না করায় তিনি কোনো পাসপোর্ট নেননি। সম্প্রতি অসুস্থ মা’কে দেখতে দেশে আসার পরিকল্পনা করেন। এজন্য গত জানুয়ারিতে প্যারিস দূতাবাসে এমআরপি পাসপোর্টের আবেদন করেন। দেশে তার পুলিশ ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হয় এবং সে রিপোর্টও জমা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। কিন্তু পাসপোর্ট অধিদপ্তর ভেরিফিকেশন রিপোর্ট না পাওয়ার কথা বলছে। বিষয়টি নিয়ে তার পক্ষ থেকে স্বজনরা পাসপোর্ট অধিদপ্তরে যোগাযোগ করলে সেখানকার সংশ্লিষ্ট অফিসার বলছেন, মিজানুর রহমানের একটি এমআরপি পাসপোর্ট রয়েছে। ওই পাসপোর্ট প্রদর্শন করলেই তাকে নতুন পাসপোর্ট দেয়া হবে। কিন্তু স্বজনদের দাবি, মিজানুর এর আগে কখনও এমআরপি পাসপোর্ট নেননি। তার এমআরপি থাকার প্রমাণ চাইলে ওই অফিসার তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। মিজানুরের ভাই সাইফুর রহমান বলেন, অফিসারের কাছে জানতে চেয়েছি তারা কিসের ভিত্তিতে আমার ভাইয়ের পুরনো এমআরপি থাকার কথা বলছেন। কিন্তু তারা সেটা বলতে চান না। যদি তাদের কাছে তথ্য থাকে তবে পাসপোর্ট নম্বরও থাকার কথা। অথচ সেটা তারা প্রকাশ না করে অনুমানের ভিত্তিতে বলছেন পুরনো পাসপোর্ট দেখাতে। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর বলছে, একজন প্রবাসীর পাসপোর্ট না থাকার ১০টি কারণ থাকতে পারে।

যে ব্যক্তির পাসপোর্ট নেই তাকে ডকুমেন্ট দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, তার পাসপোর্টটি নেই। তাহলেই তিনি পাসপোর্ট পেতে পারেন। পাসপোর্ট আবেদন এবং পাসপোর্ট পেতে তার কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে পাসপোর্টে জট লাগে। তখন থেকে এমআরপি ইস্যু বন্ধ করে দেন কর্তৃপক্ষ। এরপর থেকে শুধু মাত্র ই-পাসপোর্ট দেয়া হচ্ছে। প্রবাসীরা বেশি ই-পাসপোর্ট আবেদন করছেন। এ বিষয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. আইয়ুব চৌধুরী গতকাল মানবজমিনকে বলেন, ‘যে সব প্রবাসী পাসপোর্ট পেতে আবেদন করবেন তাদের পুরনো পাসপোর্টটি জমা দিতে হবে আবেদনের সঙ্গে। যদি কারো পাসপোর্ট হারিয়ে যায় তাহলে তাকে বিভিন্ন তথ্য ও দলিল দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, তার পাসপোর্টটি হারিয়ে গেছে। তাহলেই তিনি পাসপোর্টটি পাবেন। নইলে তিনি পাসপোর্ট পাবেন না। একজনের পাসপোর্ট হারিয়ে যেতেই পারে। বা পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। পাসপোর্ট আইনে এমন কোনো রুল নেই যে, কোনো ব্যক্তির পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে বা মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে তিনি পাসপোর্ট পাবেন না।’ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, একজন ব্যক্তির পাসপোর্ট না থাকার কারণ হচ্ছে ১০টি। যেমন- বিমানে করে বা জাহাজে করে এক দেশ থেকে আরেক দেশে গেছেন সেই বাহনে হারিয়ে যাওয়া, চুরি হওয়া, পাসপোর্ট সারেন্ডার করা এবং অন্য দেশে জন্মগ্রহণ হওয়াসহ ১০ টি কারণ আছে। যদি ওই ব্যক্তি প্রমাণ দেখাতে পারেন যে, তার ওই ১০ টির মধ্যে একটি কারণে বা একাধিক কারণে পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে তাহলে তিনি পাসপোর্ট পাওয়ার উপযুক্ত হবেন। পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পাসপোর্টের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রবাসীরা দিন দিন দূতাবাসগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন।

অনেক প্রবাসী একাধিকবার আসছেন দূতাবাসগুলোতে। এতে তাদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন দূতাবাসের কর্মকর্তারা। সূত্র জানায়, বিশেষ করে ইতালি ও ফ্রান্সে এই সমস্যা প্রকট। সেই দেশে নতুন পাসপোর্ট ছাড়া সেখানে আবেদনকারীদের কাজের কোনো অনুমতি মিলবে না। অনেকেই আগের পাসপোর্টের তথ্যের সঙ্গে বর্তমান এনআইডি ও জন্ম নিবন্ধন সনদে তথ্যে গরমিল থাকায় নতুনভাবে পাসপোর্ট করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন প্রবাসীরা। পাসপোর্টের দাবিতে ইতালির রাজধানী রোমের বাংলাদেশ দূতাবাসে মঙ্গলবার দিনভর বিক্ষোভ করেছেন প্রবাসীরা। সংক্ষুব্ধ শতাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি চ্যান্সরি কমপ্লেক্সে ঢুকে পড়েন। তারা সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর চালান। এতে প্রধান ফটকের দু’টি দরজা এবং মূল্যবান আসবাবপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবশ্য তৎক্ষণাৎ ইতালির পুলিশ এসে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূতসহ দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে টানা সাড়ে ৪ ঘণ্টার দেন-দরবার শেষে বিক্ষোভকারীরা ১৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট না পেলে দলবদ্ধ আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে স্থানত্যাগ করে। তারা বাংলাদেশের সরকার প্রধান বরাবর দু’টি স্মারকলিপিও দিয়েছেন। রোমে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। মানবজমিন-এর সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, বয়সসহ পাসপোর্টের তথ্য সংশোধনে দীর্ঘদিন ধরে কয়েক হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি অনিয়মিতভাবে চ্যান্সরি কমপ্লেক্স এলাকায় বিক্ষোভ করে আসছেন। তাদের অন্তত ৭০ শতাংশের বয়স ৬-১২ বছর কমানোর আবেদন রয়েছে। যা সরকারের বিদ্যমান নীতিমালা এবং সিস্টেমে কভার করে না।

রাষ্ট্রদূত বলেন, আবেদনকারীদের প্রতি দূতাবাস সহানুভূতিশীল, কিন্তু অনেকে ৬-১২ বছর পর্যন্ত বয়স কমাতে চান, যা অসম্ভব। তারপরও তাদের দাবিনামা এবং স্মারকলিপি গ্রহণ করা হয়েছে এবং মানবিক বিবেচনায় সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলে তা উত্থাপনের আশ্বাস দিয়ে আপাতত বিক্ষোভকারীদের শান্ত করা গেছে। উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ ও সঠিক তদন্তের মাধ্যমে পাসপোর্ট সমস্যার সমাধান চেয়ে আজ বৃহস্পতিবার দূতাবাসের সামনে মানবন্ধন কর্মসূচি পালন করবে গ্রিসে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ‘আমরা গ্রিস প্রবাসী বাংলাদেশি রেমিট্যান্স যোদ্ধা’- নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। এ কর্মসূচির আয়োজকরা অভিযোগ করেছেন, তারা এনালগ পাসপোর্টের যুগে গ্রিসে গেছেন। বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও যে পাসপোর্ট আন্তর্জাতিকভাবে নিজ জাতীয়তা ও পরিচয় প্রত্যায়িত করে সেই পাসপোর্ট তাদের কাছে নেই। এমআরপি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে দীর্ঘ ৬-৭ মাস ধরে দূতাবাসে গিয়েও পাসপোর্টের হদিস পাচ্ছেন না তারা। রেমিট্যান্স যোদ্ধা হিসেবে বৈধতা তো দূরের কথা নিজেকে বাংলাদেশি হিসেবে তারা প্রমাণ করতে পারছে না। প্রয়োজনীয় নথি ও ফি দিয়ে আবেদন করেও তারা জানতে পারছেন না কেন তাদের পাসপোর্ট দেয়া হচ্ছে না। এ ভোগান্তি নিরসনে তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান। পাসপোর্ট সংশোধনসহ এ সংক্রান্ত সকল ভোগান্তি নিরসনের দাবিতে ২৯শে আগস্ট প্যারিস দূতাবাসের সামনে মানবন্ধন কর্মসূচি দিয়েছে ‘আমরা বাংলাদেশের সকল রেমিট্যান্স যোদ্ধা’- নামে আরেকটি সংগঠন। ইতালি ও ফ্রান্স প্রবাসীদের তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এবং জন্মনিবন্ধন অনুযায়ী পাসপোর্ট সংশোধনের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
এই ওয়েবসাইটের লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
প্রযুক্তি সহায়তায়: রিহোস্ট বিডি