চুল কাটতে এসেছি। চেনা সেলুন। প্রতিনিয়ত এখানেই আসা হয়। গতবার চুল-দাড়ি কাটিয়েছিলাম ১০০ টাকায়। কিন্তু এবার নেয়া হচ্ছে ১২০ টাকা। বিশ টাকা বেশি নেয়ার কারণ হিসেবে তারা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কথা বলছেন। তালতলার একটি সেলুনে বসে কথাগুলো বলছিলেন জোনায়েদ। তিনি বলেন, আমাদেরও তো বেশি দামে জিনিসপত্র কিনতে হয়। এখানেও বেশি দিতে হচ্ছে। শুধুমাত্র আমাদেরকেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এ বিষয়ে নরসুন্দর বাবলু বলেন, সবকিছুর দামই তো বাড়তি। বিদ্যুৎ, পানি ও দোকান ভাড়াও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সেবার মূল্য না বাড়িয়ে উপায় নেই।
শুধুমাত্র সেলুন খরচই না। দ্রব্যমূল্যের অজুহাতে বেড়েছে প্রায় প্রতিটি সেবার মূল্য। ইচ্ছামতো বাড়ানো হয়েছে সিএনজি, রিকশা ও লেগুনা ভাড়া। সেই সঙ্গে বেড়েছে হোটেল, টেইলার্স, জুতা মেরামত, লন্ড্রি ও হাসপাতালের সেবা খরচও।
ভাড়া বেড়েছে রিকশা-সিএনজি ও লেগুনার: তামিম হোসেন। অফিসের কাজে প্রতিদিন রিকশা ব্যবহার করে পশ্চিম আগারগাঁও থেকে শিশুমেলায় যান তিনি। রিকশা ভাড়া বাড়ানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, পশ্চিম আগারগাঁও থেকে শিশুমেলার দূরত্ব অনেক কম। তবুও ত্রিশ টাকা নেয়া হচ্ছে। ত্রিশ টাকার নিচে কোনো রিকশাচালক যেতে চান না। কিন্তু এক মাস আগেও ছিল ২০ টাকা। আমিরুল ইসলাম নামের আরেক যাত্রী বলেন, আগারগাঁও থেকে ফার্মগেটের রিকশা ভাড়া ৯০ থেকে ১০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কিছুদিন আগেও এই পথে ভাড়া ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা। প্রায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা ভাড়া বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, শুধুমাত্র এই রুটেই না, সব রুটেই রিকশার ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে রিকশাচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, সবকিছুর দাম বেড়েছে। এ জন্য আমরা যাত্রীদের কাছে কিছু টাকা বাড়িয়ে চাচ্ছি। জিনিসের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে আগের ভাড়া নিয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা সম্ভব না। সব পরিবহনের ভাড়া বাড়ে, আমরা বাড়ালেই সমস্যা হয়।
বাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে সিএনজি ভাড়াও। সিএনজিতে ফার্মগেট থেকে পল্টনের ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২৫০ টাকা। এর আগে ২০০ টাকায় পল্টন যাওয়া যেত বলে জানান সিএনজি যাত্রী শাহেদ।
তবে সিএনজি চালকরা বলছেন, জিনিসের দাম বাড়ানোর কারণে আমরা মানুষের কাছে ২০-৩০ টাকা আবদার করছি। কেউ দিচ্ছে আবার কেউ দিচ্ছে না। কারও উপরে পেশার দেয়া হচ্ছে না। রাস্তায় জ্যাম থাকায় কিছু সময় বেশি নেয়া হয় বলেও জানান তারা।
সিএনজি চালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, জিনিসের দাম বাড়ার কারণে ভাড়া না বাড়ালে সংসার চলবে না। এ জন্য আমাদের ভাড়া বাড়ানোর বিকল্প নেই। গ্যাসের দাম বেড়েছে কয়েকবার। আরেক সিএনজি চালক লিটন বলেন, প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা মানুষের কাছে চেয়ে কিছু টাকা বেশি নিচ্ছি। কিন্তু কারও কাছে জোর করা হচ্ছে না। আয় হোক বা না হোক সিএনজির পেছনে আমাদের প্রতিদিন ১৫০০ টাকা খরচ করতেই হয়। কোনো কোনোদিন এই টাকা উঠাতে পারি না। মিটারে সিএনজি না চালানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে মিটারে গাড়ি চালিয়ে সংসার চালানো কঠিন।
এ ছাড়া লেগুনার ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। ফার্মগেট থেকে ৬০ ফিটের ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২৫ টাকা। যেটা আগে ছিল ১৫ টাকা। গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে লেগুনা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে বলে জানান চালকেরা। তারা বলেন, গ্যাসসহ প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। এ জন্য আমরা ভাড়া বাড়িয়েছি।
প্যান্ট-শার্ট-পাঞ্জাবি সেলাইয়ের খরচ বেড়েছে: দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে প্যান্ট-শার্ট-পাঞ্জাবি সেলাইয়ের খরচ বেড়েছে ২০০ টাকা পর্যন্ত। এ বিষয়ে স্টুডেন্ট টেইলার্সের কারিগর আব্দুল মতিন বলেন, জিনিসের যে পরিমাণ দাম বেড়েছে তাতে প্যান্ট-শার্ট সেলাইয়ের খরচ না বাড়িয়ে উপায় নেই। কিছুদিন আগে আমরা একটা শার্ট-প্যান্ট তৈরি করতে নিতাম মোট ৭০০ টাকা। এখন ৮০০ টাকা নিচ্ছি। আমাদের আশেপাশের দোকানগুলোতে প্যান্ট-শার্ট সেলাইয়ের খরচ নেয়া হচ্ছে ১ হাজার টাকা। তারা কিছুদিন আগে ৮০০ টাকা করে সেলাই করতো। আসলে সেলাই উপকরণগুলোর দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে সুতার দাম কম ছিল কিন্তু এখন বেড়েছে। এখন একটি মেশিন কিনতেও অনেক টাকা খরচ করতে হয়। অন্যদিকে খাদ্যের দাম তো অনেক বেড়েছে। এক লিটার সয়াবিন তেল দুই শ’ টাকা। আটা, ময়দা, চাল, ডাল, পিয়াজ, সবজি সবকিছুর দাম বাড়তি। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে সেলাই খরচ বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নেই।
জুতা সেলাই ও পলিশ খরচও বেড়েছে: একই অবস্থা জুতা মেরামতের খরচেও। এখন একটি জুতা পলিশ করতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা নেয়া হচ্ছে। যেটা আগে ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা। নবতরণ নামের একজন জুতার কারিগর বলেন, ২০ টাকা নিয়ে এখন আর পোষাচ্ছে না। এজন্য জুতা পলিশ করতে ৩০ টাকা নেয়া হয়। আর জুতা সেলাই ও পলিশ খরচ নেয়া হয় ৫০ টাকা।
হোটেলে খাবারের মূল্য বেড়েছে: এদিকে জিনিসের দাম বাড়ায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে খাবার হোটেলে। আগে ঢাকায় কোনো ভাতের হোটেলে ভাত, ডিম ও সবজি খেতে খরচ হতো কমবেশি ৩০-৩৫ টাকা। কিন্তু, খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে একই খাবার এখন খেতে হচ্ছে ৫০ টাকায়। শুধু যে ভাতের হোটেলেই দাম বেড়েছে তাই নয়, বেড়েছে বড় রেস্তরাঁগুলোতেও। আগে একটি রাইস প্ল্যাটারের (ফ্রাইড রাইস, এক পিস ফ্রাইড চিকেন, চায়নিজ সবজি) দাম ছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, যা এখন বিক্রি হয় ১৯০ থেকে ২২০ টাকায়। খাবারের দাম বেশি রাখা প্রসঙ্গে হোটেলের বিক্রেতা জলিল জানান, দেড়শ’ টাকার তেল এখন দুইশ’ টাকায় কিনতে হচ্ছে, ডিম, ময়দা সবকিছুর দামই বেড়েছে। এ জন্য দাম কিছুটা বাড়ানো হয়েছে।