1. rashidarita21@gmail.com : bastobchitro :
দুর্ঘটনা মৃত্যু দু’টোই বেড়েছে | Bastob Chitro24
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৭ পূর্বাহ্ন

দুর্ঘটনা মৃত্যু দু’টোই বেড়েছে

ঢাকা অফিস
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০২২

ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলনের চার বছর

স্বপ্নই রয়ে গেল নিরাপদ সড়ক। আন্দোলন-কর্মসূচি কোন কিছুই কাজে আসেনি। দিন যায় বছর যায় সড়কের নৈরাজ্য থামে না। সড়ক-মহাসড়ক এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। কিন্তু এই মৃত্যুর সারী দীর্ঘ হচ্ছে প্রতিনিয়তই। কোন কোন মৃত্যুর ঘটনা আড়ালেই রয়ে যায়। মিডিয়ায় আসে না। সে হিসেবটাও কম নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ফলে নিঃস্ব অসহায় হয়ে পড়ে একটি পরিবার। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর কারণে সারা জীবনেও থামে না অন্য সদস্যের কান্না। সড়ক নিরাপত্তার আইন হয়। প্রতিকারের আশ্বাস আসে কিন্তু পূরণ হয়না বছরের পর বছরেও। চার বছরে সরকার থেকে নানা ধরনের আশ্বাস দেয়া হলেও সড়কে মানুষের নিরাপত্তা বাস্তবায়নে কোনো আইনেরই সঠিক প্রয়োগ দেখা যায়নি। গত দুই সপ্তাহ আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় এক দিনেই ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এভাবেই প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে তাজা প্রাণ।

নিরাপদ সড়কের ক্ষেত্রে অবকাঠামো নির্মাণের সময় পরিকল্পনার দুর্বলতার বিষয়টি তুলে ধরা। প্রকল্পের মূল পরিকল্পনায় অবকাঠামোর বিষয়টা না থাকা। ট্রাফিক ওরিয়েন্টেড পরিকল্পনায় যানবাহনকে প্রাধান্যের সাথে সাথে পথচারীর বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। ভারী যানবাহনের দক্ষ চালকের যে ঘাটতি সেটা দুর্ঘটনার ফাঁদ তৈরি করছে বলে মনে করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।
চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটই গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা। নিজেদের হীনস্বার্থে গণপরিবহনে নৈরাজ্য টিকিয়ে রাখে। সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে চাঁদাবাজি-দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। যত বেশি অব্যবস্থাপনা-নৈরাজ্য, তত বেশি অবৈধ উপার্জন এই নীতিতেই চলছে সিন্ডিকেটের কালো থাবা। গণপরিবহন খাতে বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি হয়। দৈনিক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদা, বাস-মিনিবাস নির্দিষ্ট পথে নামানোর জন্য মালিক সমিতির চাঁদা, রাজধানী ও এর আশেপাশে কোম্পানির অধীনে বাস চালাতে দৈনিক ওয়েবিল বা গেট পাশ চাঁদা। এর বাইরেও বহু রকমের চাঁদা রয়েছে এবং এসবের সাথে প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলের লোকজন জড়িত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে রশিদ ও সিøপ লিখে চাঁদাবাজি চলে। এসব নানা অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
গতকাল শুক্রবার নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের চার বছর পূর্তিতে কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে সড়কে অবস্থান নেয় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সক্রিয় সংগঠন নিসআ। এসময় আন্দোলনরত সংগঠনের কর্মীরা এসব কথা বলেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, রাজিব দিয়া হত্যার পর আমরা যে দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, সে দাবির একটিও আমরা বাস্তবায়ন হতে দেখিনি। দাবি পূরণ হলে রাস্তায় ঠিকই মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো। গতকাল ছিলো নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের চার বছর। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীতে বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহতের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা। ওইদিন জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বেপরোয়া বাসের চাপায় রাজধানীর রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দিয়া খানম মিম ও আব্দুল করিম রাজীব নিহত হন। এর প্রতিবাদে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা, স্থবির হয়ে পড়ে যান চলাচল। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন দেশে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ওই আন্দোলনে অংশ নেয়া থেকে বাদ যায়নি। রাজধানীতে ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকরণ কীভাবে করতে হয় ও যানবাহন চলাচলে কীভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হয় শিক্ষার্থীরা তা সব মহলকে দেখিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলন দেখিয়ে দেয়, আইনের রক্ষক যে পুলিশ, তাদের চালকও লাইসেন্স ছাড়া, চলার অনুপযোগী গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামছে। সচিব, সরকারি কর্মকর্তা কাউকেই ছাড়ে না তারা। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই রাস্তায় চলাচলকারী সব যানবাহনের লাইসেন্স চেক করেন, চালকের লাইসেন্স চেক করেন।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে পুরো বাংলাদেশকে অচল করে শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলনের পর চার বছর পেরিয়ে গেছে। চাপের মুখে একটি আইন করা হয় সেই আইনে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকের শাস্তি বাড়ার বিধান আসে। কিন্তু আইনের বিরোধীতা করতে থাকেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বিক্ষোভ-কর্মবিরতির মুখে আইন শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে কোনো আইনই সড়কে বাস্তবায়িত হচ্ছে কী না তা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন তুলে যাচ্ছে নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন বলছে, প্রতি বছর চার হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। আরও অগুনতি মানুষ গুরুতরভাবে আহত হচ্ছে, মেনে নিতে হচ্ছে পঙ্গু জীবন।
জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে ময়মনসিংহের ত্রিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী, স্ত্রী আর ছয় বছরের সন্তানের প্রাণ যায় দ্রুতগামী ট্রাকের ধাক্কায়। সেই নারী ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা তার মৃত্যুর সময়ই জন্ম নেয় তার গর্ভের শিশু। সেই ঘটনা পুরো দেশকে নাড়িয়ে দেয়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে তার জন্য ৫ লাখ টাকা দিতে বলেছে হাইকোর্ট। সেই শিশুটির ঠাঁই হয়েছে ছোটমণি নিবাসে। শিশুটির একমাত্র স্বজন দাদা বেঁচে থাকলেও নাতিকে লালন-পালনের সামর্থ্য তার নেই। হাসপাতালে প্রায় দুই সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে গতকাল শুক্রবার তাকে ঢাকার আজিমপুরে ছোটমণি নিবাসের উদ্দেশে পাঠানো হয় বলে ময়মনসিংহ সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আবু আব্দুল্লাহ মো. ওয়ালিউল্লাহ জানান। মৃত্যুর মুহূর্তে মা রত্নার পেট ফেটে এক মেয়েশিশু জন্ম নেয়। সে সময় নবজাতকের ডান হাতের দুই জায়গায় ভেঙে যায়। তাছাড়া পরে তার জন্ডিস, শ্বাসকষ্ট ও রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। সমাজসেবা কর্মকর্তা ওয়ালিউল্লাহ বলেন, সব প্রক্রিয়া শেষে হাসপাতাল থেকে শিশুটিকে ঢাকার উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে। দাদা যখন ইচ্ছা নাতিকে দেখতে পারবেন। কখনও সামর্থ্য হলে তিনি নাতিকে ফেরত নিতে পারবেন। প্রয়োজন হলে ১৮ বছর পর্যন্ত সরকারের তত্ত্বাবধানে থাকবে শিশুটি।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৪৫ লাখ। অথচ লাইসেন্সধারী চালক আছে তার অর্ধেক। অর্ধেক যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ এখন লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৬৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। পরের বছর সেই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয় ৪ হাজার ১৩৮ জন। ২০২০ সালে মহামারীর কারণে দীর্ঘ লকডাউনে মৃত্যুর সংখ্যা সামান্য কমে ৩ হাজার ৯১৮ জন হয়। এ বছর সাত মাসেই সে সংখ্যা পৌঁছেছে ৩ হাজার ৫০২ জনে। গড়ে প্রতিদিন সড়কে প্রাণ গেছে অন্তত ১৪ জনের।
বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ বছরে সারাদেশে ১৫ হাজার ১৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১৭ হাজার ৮৮৬ জনের। ৩২ হাজার ৩৩০ জন আহত হয়েছেন। বাংলাদেশ রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ২০২১ সালে দেশে ৫ হাজার ৩৭১টি দুর্ঘটনায় অন্তত ৬ হাজার ২৮৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও ৭ হাজার ৪৬৮ জন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ মতে, ২০২০ সালে ৪৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৬৮৬ জন নিহত ও ৮৬০০ জন আহত হয়েছে। ২০২১ সালে ৫৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৮০৯ জন নিহত ৯০৩৯ জন আহত হয়েছে। ২০২০ /২০২১ সালে লকডাউলে দীর্ঘদিন গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরেও সড়ক দুর্ঘটনা কমেনি। সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সকলে নানান প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই অঙ্গীকার পুরণ হয়নি। বরং সড়কে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, ভাড়া নৈরাজ্য দিন দিন বেড়েই চলছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনায় চলমান এমন নৈরাজ্যের মধ্যে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বেপরোয়া বাসের চাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ২ জন শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ শ্লোগান দিয়ে শিক্ষার্থীরা সড়কে-যানবাহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে, দেশে প্রথমবারের মতো ইমার্জেন্সি লেন তৈরি করে সারা দুনিয়ায় প্রশংসিত হয়। তারা যানবাহনের ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা শুরু করলে দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির যানবাহন আটকে যায়।
শিক্ষার্থীদের সেই অহিংস স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলন আমাদের দেখিয়েছিল দেশের সড়ক পরিবহন খাতের দায়হীন, মায়াহীন সঙ্কটাপন্ন চেহারা। ব্যাপক জনসমর্থিত সেই আন্দোলন চলাকালে সরকার শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি মেনে নিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদেরকে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার আহবান জানায়। শিক্ষার্থীরা সরকারের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যায়, কিন্তু সড়কে আর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হয়নি।
বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, বছরের পর বছর গেলেও লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে স্টিয়ারিংয়ের বিপদ থেকে পরিত্রাণ পায়নি বাংলাদেশ। কেবল পথচারীদের নিরাপত্তা দিতে পারলেই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। দুর্ঘটনায় বছরে যত মানুষ মারা যায়, তার ৪৯ শতাংশ পথচারী। এসব দুর্ঘটনার একটি বড় অংশ ঘটে মহাসড়কে। ৫৯ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভারী যানবাহনের নিচে পড়ে পথচারীর মৃত্যু হচ্ছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সড়কে গণপরিবহন যেমন চলছে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে, তেমনি অধিকাংশ ব্যক্তিগত যানবাহন চলছে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে। ফলে অহরহ সড়ক দুর্ঘটনা, গণপরিবহনে যাত্রী হয়রানি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ইত্যাদি নিত্যদিনের দুর্ভাগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নানারকম প্রতিশ্রুতি দেন, কমিটি গঠন করেন, বৈঠক করেন, সুপারিশমালা তৈরি করেন। অতঃপর এসব তৎপরতার মধ্যেই আরেকটি ঘটনা ঘটলে মানুষের মনোযোগ সরে যায়, সেই সুযোগে কর্তৃপক্ষের তৎপরতাও থেমে যায় এবং বিরামহীনভাবে ঘটতে থাকে দুর্ঘটনা, চলতে থাকে নানারকম অনিয়ম। এভাবেই চলছে দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
এই ওয়েবসাইটের লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
প্রযুক্তি সহায়তায়: রিহোস্ট বিডি