দেশে আপাতত বন্যার কোনো ঝুঁকি নেই। তবে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি বাড়ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়ার স্বাক্ষর করা পূর্বাভাসের বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড পূর্বাভাসে জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, অপরদিকে পদ্মা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। উভয় নদীর পানি সমতল আগামী ৪৮ ঘণ্টায় হ্রাস পেতে পারে। মনু ও খোয়াই ব্যতীত দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের প্রধান নদ-নদীর অববাহিকায় আগামী পাঁচ দিন বন্যার কোনো ঝুঁকি নেই।
এদিকে সাতক্ষীরা জেলা সংবাদদাতার পাঠানো তথ্যে জানা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে উপকূলীয় জনপদ। গতকাল বেলা ১১টা পর্যন্ত তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেলে জোয়ারের তোড়ে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের পশ্চিম দুর্গাবাটি এলাকায় ভাঙনের সৃষ্টি হয়। খোলপেটুয়া নদীতে চলে যায় ১০০ ফুট বেড়িবাঁধ। বাঁধের এই অংশে দেড় থেকে দুই ফুট অবশিষ্ট থাকায় লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেনি। তবে রাতে জোয়ারে সম্পূর্ণ বাঁধ ধসে প্লাবিত হতে শুরু করে জনপদ।
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী নজরুল ইসলাম বলেন, স্থানীয়দের নিয়ে রাতে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করা হলেও শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। রাত ১২টার দিকে বাঁধের অবশিষ্ট অংশ নদীতে চলে যায়। ১৫০ ফুট মতো বাঁধ বিলীন হয়েছে। ইতোমধ্যে তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে মাছের ঘের। এভাবে বিকেল পর্যন্ত জোয়ার চলবে। এতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগীয় উপ-প্রকৌশলী জাকির হোসেন বলেন, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় বাঁধ সংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু বাঁধটি রক্ষা করা যায়নি। এখন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাঁধটি সংস্কারের ব্যবস্থা করা হবে।
অপরদিকে বরগুনা জেলা সংবাদদাতা জানান, বরগুনায় বেরিবাঁধ ভেঙে এবং জোয়ারের পানি ঢুকে দুই উপজেলার ১৮ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে রান্না-বান্নাসহ দৈনন্দিন কাজে সমস্যা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্ধকোটি টাকার মাছের ঘের। ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তালতলী ও পাথরঘাটার হাজার হাজার মানুষকে। পায়রা নদীর জোয়ারের পানির চাপে তালতলীর তেঁতুলবাড়ী এলাকার নদীর ১০০ মিটার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে ৮ গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে কমপক্ষে ৫০টি মাছের ঘের ও ৮টি গ্রামের কয়েকশ বাড়ি প্লাবিত হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের চলাচলে ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে। রান্নাঘরে পানি প্রবেশ করায় এসব এলাকার কয়েকশ পরিবারে রান্না বন্ধ রয়েছে।
এছাড়া, পূর্ণিমার প্রভাবে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে উপজেলার ১০টি গ্রাম। এতে সাধারণ মানুষের চলাচলে ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে। পাথরঘাটার ট্যাংরা, হাড়িটানা, কোরালিয়া, গহরপুর, নিজলাঠিমারা, রুহিতা, হাজির খাল, বাদুড়তলা, চরলাঠিমারা এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়। এতে শতাধিক পুকুর ও ১০টি ঘেরের মাছ ভেসে যায়।
এসব এলাকার স্থানীয়রা জানান, তালতলীর নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের তেতুলবাড়িয়া এলাকায় জোয়ারের তীব্র স্রোতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অস্থায়ী বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এতে ওই এলাকার ৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়। পাথরঘাটার কোরালিয়া খালের বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ না থাকায় লোকালয়ে ঢুকছে জোয়ারের পানি। জোয়ারের পানির তোড়ে একাধিক স্থাপনা ও বসতঘরের মালামাল ভেসে গেছে। পাশাপাশি মৎস্য খামারেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক বাড়িঘরে দুই থেকে তিন ফুট পানি প্রবেশ করেছে।
পাথরঘাটার রুহিতা গ্রামের সালেহা বেগম বলেন, জোয়ারের পানিতে আমার বাড়িঘর সব তলিয়ে গেছে। এখন ছোট মেয়েকে নিয়ে খাটে বসে আছি। রান্নাঘর ও চুলা পানিতে ডুবে গেছে। তাই দুদিন ধরে রান্না হয়নি।
এ বিষয়ে তালতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম সাদিক তানভীর বলেন, বাঁধ ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে আলোচনা করেছি। তাদের একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। দ্রুত সংস্কারের জন্য বালির জিও ব্যাগ পাঠানো হচ্ছে পানির তোড় সামলাতে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে উপজেলা প্রশাসন থেকে সহযোগিতা করা হবে।
এদিকে বরিশাল ব্যুরো জানায়, এ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ১০টি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বর্ষার পূর্ণিমার প্রভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ কারণে নিম্মাঞ্চল ও বরিশাল নগরের কিছু কিছু এলাকায় জোয়ারের পানি ঢুকে পড়েছে। মূলত জোয়ারের সময়ে পানি বাড়লেও ভাটায় তা কমে যায়। বৃহস্পতিবার পূর্ণিমা এবং বাতাস প্রবাহিত হওয়ায় পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়।
বরিশাল পাউবোর জলানুসন্ধান বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মাসুম বলেন, বিভাগের মোট ২৩টি নদীর মধ্যে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ১০টি নদীর পানি প্রবাহ এখন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ১০টি নদীর পানিই বিপদসীমা অতিক্রম করেছে।
এর মধ্যে বরিশাল জেলার কীর্তনখোলা নদীর পানি ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, ভোলা খেয়াঘাট এলাকার তেঁতুলিয়া নদীর পানি ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দৌলতখান উপজেলার সুরমা ও মেঘনা নদীর পানি ৭৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, তজুমদ্দিন উপজেলার সুরমা ও মেঘনা নদীর পানি ৯৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, ঝালকাঠি জেলার বিশখালী নদীর পানি ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার বুড়িশ্বর, পায়রা নদীর পানি ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, বরগুনা জেলার বিশখালী নদীর পানি ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, পাথরঘাটা উপজেলার বিশখালী নদীর পানি ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, পিরোজপুর জেলার বলেশ্বর নদীর পানি ৯ সেন্টিমিটার এবং উমেদপুরের কঁচা নদীর পানি ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জলানুসন্ধান বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মাসুম বলেন, এটি বন্যা পরিস্থিতি না। নদী প্রধান বরিশাল বিভাগের বর্ষা মৌসুমের স্বাভাবিক চিত্র। বরিশাল আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক প্রনব কুমার রায় বলেন, ভারতের উড়িষ্যা অঞ্চলে একটি লঘুচাপ বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু বরিশালে স্বাভাবিক আবহাওয়া বিদ্যমান। মূলত পানি বৃদ্ধি পেয়েছে বর্ষা মৌসুমের জোয়ারের প্রভাবে।