1. rashidarita21@gmail.com : bastobchitro :
ওরা এখন রাখাল ছেলে | Bastob Chitro24
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২০ পূর্বাহ্ন

ওরা এখন রাখাল ছেলে

ঢাকা অফিস
  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ৮ এপ্রিল, ২০২২

এখনো শিশুকাল পেরোইনি। দুরন্তপনায় বেড়ে উঠছে ওরা। বাবার সঙ্গে সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকে। করোনার আগে স্কুল ছিল তাদের। এখন আর স্কুলে যায় না কেউ। কাজে, খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকে সব সময়। ভবিষ্যতের চিন্তা এখনো তাদের মাথায় প্রবেশ করেনি। জীবন নিয়ে ভাবনাও নেই তাদের।

এসবের কিছুই বোঝার বয়স হয়নি তাদের। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর অববাহিকায় জেগে ওঠা চালুয়াবাড়ির চরে কথা হয় রাকিব, আল আমিন, সাগর, জীবন, সোহাগদের সঙ্গে।
কাকডাকা ভোরেই ঘুম ভাঙে তাদের। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে ছুটে যায় গোয়ালঘরের দিকে। গরু বের করে উঠানে বেঁধে রাখে। খড় পানি খেতে দেয়। তারপর নিজেরা মুখ হাত ধুয়ে নেয়। মা পান্তা থালায় বেড়ে খেতে ডাকে। কাঁচা মরিচ, পিয়াজ সঙ্গে আলুভর্তা। খাবার শেষে বাবার সঙ্গে বের হয় মাঠের কাজে। কখনো সবজি ক্ষেত, কখনো ধানক্ষেত আবার কখনো বীজতলায় ফসল পরিচর্যার কাজ করে। যখন মৌসুম থাকে না তখন বন্ধুদের সঙ্গে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়। খেলাধুলা করে। নদীতে গোসল করে। মাছ ধরে।
মাসখানেক আগে বগুড়ার সোনাতলা থানার অফিসার ইনচার্জ রেজাউল করিম রেজা পেশাগত কাজে পাশের উপজেলা সারিয়াকান্দির চালুয়াবাড়ির চরে গিয়েছিলেন। সেখানে রাকিব, আল আমিন, সাগর, জীবন, সোহাগদের সঙ্গে তার দেখা। ওই শিশু-কিশোরা তখন গরুর পাল সামলাতে ব্যস্ত। তাদের ব্যস্ততা দেখে রেজাউল করিম রেজা দাঁড়িয়ে যান। কৌতূহলবশত তাদের কাছে ডেকে নেন। জিজ্ঞেস করে এখন তো স্কুলের সময়, তোমরা স্কুল যাওনা? কিশোররা সবাই উত্তর দেয়, করোনার আগে স্কুল যেতাম। এখন যাই না। পুলিশ অফিসার আবারো জিজ্ঞেস করে কীভাবে সময় কাটে তোমাদের? ওরা উত্তর দেয় গরু হাঁকিয়ে (গরুকে ঘাস খাওয়ানোর কাজ)। কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে কথা বলে অফিসার শিশু-কিশোরদের একত্রিত করে মুঠোফোনে ছবি তোলেন। ভিডিও করেন। পরে থানায় ফিরে এসে রাতে এ প্রতিবেদকের হোয়াটসঅ্যাপে ছবি এবং ভিডিওগুলো পাঠান।
ছবিগুলো দেখে কবি জসীম উদ্দীনের ‘রাখাল ছেলে’ কবিতার কথা মনে পড়ে যায়। “রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! বারেক ফিরে চাও/ বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?’/ ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ,/ কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা,/ সেথায় আছে ছোট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,/ সাঁঝ-আকাশের ছড়িয়ে-পড়া আবীর রঙে নাওয়া,/ সেই ঘরেতে একলা বসে ডাকছে আমার মা/ সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না।”
পরের দিনই চালুয়াবাড়ির চরে পৌঁছালাম। বাইকে টানা দেড় ঘণ্টায় বগুড়া শহর থেকে সারিয়াকান্দিতে পৌঁছাই। তারপর নৌকায় চালুয়াবাড়ি পৌঁছাতে আরও দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। নৌকা থেকে শুকনা যমুনার বাঁকে পা ফেলি। তখন দুপুর সাড়ে ১২টা। সূর্য বেশ তাপ ছড়াচ্ছে। বালি গরম হয়ে উঠেছে। জুতা ভেদ করে তাপ পায়ের চামড়া পর্যন্ত ছড়িয়েছে। বালির পথে হাঁটছি। পথ এগোয় না। কিছু দূর যেতেই দেখা মেলে রাকিব, আল আমিন, সাগর, জীবন, সোহাগদের সঙ্গে। যথারীতি গরুর পালে নজর রাখছে। গরুগুলোর ছেড়ে দেয়া। আপন মনে চরের বিষমুক্ত ঘাস খাচ্ছে। পাশে ওই শিশু-কিশোরের দল নিজের মধ্যে খেলাধুলা করছে। দৌড়ঝাঁপ করছে। কোথাও ছায়া নেই। দৃষ্টি যতদূর যায় বালি আর বালি। পাশে যমুনা নদী খালের মতো বয়ে গেছে। কোথাও হাঁটু পানি আর কোথাও কোমর পানি। গরমে অতিষ্ঠ হলে সবাই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ব্যাগের ভেতর প্লাস্টিকের বোতলে খাবার পানি এনেছে ওরা। আর একটু পরে দুপুর হবে। তারপর গরুগুলোকে যমুনার পানিতে গোসল দিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেবে। সেই সময় প্রায় হয়ে এসেছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে গরুগুলোকে একত্রিত করার। কথা হয় তাদের সঙ্গে। স্কুলের কথাই প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলাম। করোনার আগে স্কুলে যেতো। প্রাইমারিতে পড়তো। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আর তারা স্কুলে ফেরেনি। পরিবার থেকেও চাপ নেই স্কুলে যাওয়ার। ওদের সঙ্গে কথা বলতে পাশ দিয়ে একজন বয়স্ক লোক হেঁটে যাচ্ছিলেন। স্কুল নিয়ে কথা বলায় তিনি থামলেন। বললেন, বাবা স্কুলে গিয়ে ওদের কি হবে? ওদের ভাগ্য কি বর্তমানের লেখাপড়া পরিবর্তন করতে পারবে? এখন ঘরে ঘরে বি এ পাস। চাকরি নেই। বেকার হয়ে পড়ে আছে। পরিবারে বোঝা হয়ে আছে। লেখাপড়ার কারণে ছোটখাট কাজ করতে লাজ্জা পায়। তাদের নিয়ে পরিবার বিপাকে পড়েছে। দেশে চাকরি এখন সোনার হরিণ। টাকা লাগে। লোক লাগে। চরের অভাবী মানুষদের এসবের কিছুই নেই। অযথা লেখাপড়া শিখে কি হবে? ওরা গরু হাঁকাচ্ছে হাঁকাক। এই কাজ করে বড় হলে করে খেতে পারবে।
রাখাল ছেলেদের ফের প্রশ্ন করি- এখনতো স্কুল খোলা, ক্লাসে যাচ্ছো না কেন? চরের স্কুলে স্যারেরাই ঠিকমতো আসে না। অনেক সময় স্কুলের তালাও খোলা হয় না। স্যার ম্যাডামেরা এসে কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে যায়। এজন্য স্কুলে যায় না অনেকে। পড়ালেখা করতে মন চায় না? হ্যাঁ চায়। বাড়ি থেকে কাজে পাঠায় এজন্য লেখাপড়া হয় না। কখন এসেছ গরু নিয়ে? সকালে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। কতক্ষণ ঘাস খাওয়াও গরুকে? দুপুর পর্যন্ত। আর কিছুক্ষণ পরেই বাড়িতে চলে যাবো। গরু তোমাদের আঘাত করে না? না। আমাদের চেনে। আমরা যা বলি গরু তাই করে। ডাক দিলেই কাছে আসে। অনেক সময় জিহ্বা দিয়ে আমাদের আদর করে। আমরা খেলা করি গরুর সঙ্গে। বাহির থেকে বাড়িতে যখন ঢুকি তখন গরুগুলো আনন্দে লাফালাফি করে। কাছে আসতে চায়। বাঁধা থাকে এজন্য আমরাই কাছে যাই। গায়ে হাত বুলিয়ে দেই। চোখ বন্ধ করে আদর গ্রহণ করে। গরুর সঙ্গে তাদের নিত্যদিনের সুখময় গল্প শোনায় তারা।
ওই শিশুদের পরিবার হয়তো মনে করছে শিশুদের এখন থেকেই সংসারের কাজ আয়ত্ত করালে ভবিষ্যতে অন্তত জমিজমা চাষ, গরু পালন করে জীবন পাড়ি দিতে পারবে। লেখাপড়া শেষে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ছুটতে হবে না।
সূর্য মাথার উপর চলে আসে। দুপুর হয়। রাকিব, আল আমিন, সাগর, জীবন, সোহাগরা গরুর পাল নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেয়। গরুগুলো ছেলেদের অনুসরণ করে লাইন ধরে হাঁটছে। দেখে মনে হয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
এই ওয়েবসাইটের লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
প্রযুক্তি সহায়তায়: রিহোস্ট বিডি