বিভিন্ন পয়েন্টে নিয়মিতই ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা রাত থেকে ভোর পর্যন্ত পথে পথে ওত পেতে থাকে। নির্জনে সুযোগ পেলেই তারা পথচারী, রিকশা আরোহী কিংবা অটোরিকশার যাত্রীদের ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের আক্রমণের শিকার হতে হয়। এতে নিয়মিতই ঘটছে মৃত্যু ও আহতের ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা থাকলেও ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে আরও সরব হয়েছে ছিনতাইকারী চক্র।
সম্প্রতি রাজধানীতে বেশকিছু ছিনতাইয়ের ঘটনায় হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশ সূত্র জানায়, রাজধানীতে সক্রিয় পাঁচ শতাধিক ছিনতাইকারীর তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
এসব ছিনতাইকারী উত্তরা, মিরপুর, গুলশান, রমনা, তেজগাঁও ও ওয়ারীসহ বিভিন্ন বিভাগে সক্রিয় রয়েছে। তারা নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে অপরাধ করে থাকে। এদের মধ্যে মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের জন্যও আলাদা গ্রুপ রয়েছে। যারা মোবাইল ছিনতাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে তা হাতবদল করে এবং তার আইএমইআই কোড বদল করে বিক্রি করে দেয়। ছিনতাইকারীরা কখনো মোটরসাইকেল, কখনো প্রাইভেটকার বা মাইক্রোবাস নিয়ে পথচারী বা রাস্তায় অপেক্ষমাণ ব্যক্তির কাছ থেকে মোবাইলফোন সেট, মূল্যবান সামগ্রী, ভ্যানিটি ব্যাগ, গলার চেইন ছিনিয়ে নেয়।
গত বুধবার লালবাগে রাত সাড়ে ৮টার দিকে কবির হোসেন নামের এক ব্যক্তি ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন। ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করে নগদ ১০ হাজার টাকা ও একটি মোবাইলফোন নিয়ে পালিয়ে যান। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা করানো হয়। আগেরদিন মঙ্গলবার রাতে মোজাব্বির হাসান নামের এক গণমাধ্যমকর্মী রাত সোয়া ১১টার দিকে অফিস থেকে বাসায় যাওয়ার পথে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন। ছিনতাইকারীরা তার পকেটের মোবাইলফোন নেয়ার চেষ্টা করে। এতে অল্পের জন্য রক্ষা পান তিনি। ২৭শে মার্চ ভোর ৫টার দিকে রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে দন্ত চিকিৎসক আহমেদ মাহি বুলবুল নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশ ছিনতাই দলের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে এবং ডা. বুলবুলের মোবাইলফোনটি উদ্ধার করে। ২২শে মার্চ মাহমুদ হোসাইন নামে এক ব্যক্তি শাহবাগ থেকে রিকশায় সেগুনবাগিচা যাওয়ার সময় রমনা পার্কের কাছে কয়েকজন ছিনতাইকারী মোটরসাইকেলে এসে তার কাছে থাকা মূল্যবান সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যায়।
১৭ই মার্চ কাকরাইল মোড়ে রাফি রিদভি নামের এক শিক্ষর্থীকে ছুরিকাঘাত করে মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। এতে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয় তাকে। একই দিন সাংবাদিক কামাল হোসেন তালুকদার গুলিস্তান থেকে আজিমপুর বাসায় যাওয়ার পথে ছিনতাইকারীরা তার সঙ্গে থাকা ব্যাগ ও মোবাইলফোন নিতে সজোরে ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দেয়। এতে তিনি মারাত্মক আহত হন। এ ছাড়া ২০শে ফেব্রুয়ারি যাত্রাবাড়ী সায়েদাবাদের দয়াগঞ্জ রোডের ঢাকা মোজাইক কোম্পানির সামনের পাকা রাস্তার ওপর মোশারফ হোসেন (৫৫) নামের এক সবজি বিক্রেতা নিহত হন। এসময় ছিনতাইকারীরা তার মোবাইলফোন ও টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় দুই ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই দিনে ভোর পাঁচটার দিকে রাজধানীর জুরাইনের শ্যামপুরে রাকিব নামের এক রিকশাচালককে ছুরিকাঘাত করে তার রিকশা, মোবাইলফোন ও টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় তিন ছিনতাইকারী। এরপর তাকে ঢামেকে চিকিৎসা করানো হয়।
ঈদকে ঘিরে ছিনতাই নিয়ন্ত্রণ করতে বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) হাফিজ আল আসাদ। এ ছাড়া এই সময়ে সাধারণ মানুষকে নির্জন জায়গা এড়িয়ে চলার জন্যও পরামর্শও দেন তিনি। গত মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এক রাতেই সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারী চক্রের ৫৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গ্রেপ্তারের সময় চাঁদা আদায়ের নগদ ১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৩০ টাকা, মোবাইলফোন ও ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে গত ৬ ও ৮ই এপ্রিল রাজধানীর হাজারীবাগ, চকবাজার, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও শাহবাগ থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে দেশীয় অস্ত্রসহ ছিনতাই চক্রের ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
একাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা খামারবাড়ির ডাব বিক্রেতা ইউনুস জানান, এই জায়গায় মাঝেমধ্যেই ছিনতাই হতে দেখা যায়। মোবাইল ছিনতাই করতেই বেশি দেখা যায়। কিছুদিন আগে পহেলা ফাল্গুনেও ভিড়ের মধ্যে একটি বাসের যাত্রী থেকে দুপুর ১২টার দিকে এক টোকাই ফোন টান দিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। তিনি এই ছিনতাইকারী চক্রের একাংশকে রাস্তার যেখানে সেখানে শুয়ে থাকতে প্রায়ই দেখেন। ওদের কাছে ছুরি থাকায় কিছু বলার সাহস পান না তিনি। ফার্মগেট ফুটপাথের একটি দোকানে মানিব্যাগ বিক্রি করেন মাসুদ। তিনি জানান, কিছুদিন আগে রাত ৯টার দিকে একটি বাসের জানালায় বসে একজন ফোন টিপছিলেন। সেখান থেকে এক টোকাই একটি মোবাইল ছিনতাই করে কাওরান বাজারের দিকে দৌড় দেয়। এমন ঘটনা প্রায়ই দেখতে পান তিনি। একই স্থানের এক পোশাক বিক্রেতা জানান, গত সপ্তাহে এক মেয়ের ব্যাগ থেকে মোবাইল চুরি করে দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরে মেয়েটি এসে আহাজারি করে। এগুলো ফার্মগেটের নিত্যদিনের ঘটনা। এক চা বিক্রেতা জানান, ৫ থেকে ৬ দিন আগে এক ছেলে বাস থেকে ফোন চুরি করে পালাতে যায়। পরে জনগণের হাতে ধরা খেয়ে বেধড়ক মার খায় ছেলেটা। পরে পুলিশ এসে ওকে ছেড়ে দেয়।
ফার্মগেট ও কাওরান বাজারের মাঝামাঝি ওভারব্রিজের পাশের একজন কলা বিক্রেতা জানান, রাতে এমন ঘটনা বেশি হয়। তিনি সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যান। দুই মাস আগে একটি বাস থেকে এক ছেলেকে ফোন নিয়ে পালাতে দেখেছেন তিনি। একই স্থানের চা বিক্রেতা সুজন জানায়, মেট্রোরেলের কাজের জন্য যে ফাঁকা স্থান রয়েছে সেখান থেকে ছিনতাইকারীরা পর্যবেক্ষণ করে। যানজটের সময় টার্গেট করা ব্যক্তিটির ফোন টান দিয়ে ভোঁ দৌড় দেয় তারা। প্রায় ১৫ জনকে নিয়ে গঠিত তাদের এই চক্র। দুই মাস আগে তিনি এই ঘটনার সাক্ষী।